বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৩৫ অপরাহ্ন
মাওলানা মনিরুজ্জামান:
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা মানবজীবনের জন্য অনন্য আশীর্বাদ। দৈনন্দিন জীবনে তার সুন্নতগুলো পালন করতে পারলে তা শরীরকে নিরাপদ ও সুস্থ রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। পরিচ্ছন্নতা, পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও শরীরচর্চার মতো বিষয়গুলোতে তার নির্দেশনা মানুষকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গড়তে সহায়তা করে। জীবনের প্রতিটি পর্বে তিনি যে রীতিনীতি অনুসরণ করেছেন, সেগুলোর ভেতর নিহিত রয়েছে সুস্থতার নানা উপায়। তাই তার সুন্নতকে অনুসরণ করা মানে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির পথে হাঁটা। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর কয়েকটি সুন্নতের বিবরণী উল্লেখ করা হলো।
হাত ধোয়া : হজরত রাসুল (সা.) খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুতেন, এমনকি তিনি খাওয়ার পর কুলিও করতেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল (সা.) পানাহারের ইচ্ছা করলে উভয় হাত ধুয়ে নিতেন। এরপর খাবার গ্রহণ করতেন কিংবা পান করতেন। (সহিহ বুখারি) এতে অনেক উপকার রয়েছে। জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া দূর হয়, হজমের সমস্যা দূর হয়, খাদ্যের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অক্ষুণœ থাকে, কুলি করলে মুখগহ্বর ও দাঁতে আটকে থাকা খাদ্যকণা দূর হয় এবং দাঁত ও পাকস্থলী ভালো থাকে।
পরিমিত খাদ্য গ্রহণ : হজরত রাসুল (সা.) খাদ্য গ্রহণে সংযমের শিক্ষা দিয়েছেন, যা মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনিয়ন্ত্রিত খাবার মানুষের দেহে নানা ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি করে। মিকদাম ইবনে মাদিকারাব (রা.) বলেন, আমি হজরত রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, মানুষ পেট থেকে অধিক নিকৃষ্ট কোনো পাত্র পূর্ণ করে না। মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারে এমন কয়েক লোকমা খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হলে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।’ (জামে তিরমিজি) খাদ্য গ্রহণে এমন সংযম স্থূলতা, এসিডিটি গ্যাস্ট্রিক, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও লিভারের রোগগুলো থেকে রক্ষা করে।
মিসওয়াক করা : হজরত রাসুল (সা.) দাঁত ও মুখের পরিচ্ছন্নতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। হাদিসের বর্ণনা অনুসারে তিনি ঘুমানোর আগে ও পরে, ঘরে প্রবেশের সময় ও অজুর আগে মিসওয়াক করতেন। তিনি মুমিনদের প্রত্যেক অজুর আগে মিসওয়াক করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টের আশঙ্কা না থাকত আমি তাদের প্রতি প্রত্যেক অজুর সময় মিসওয়াক করার আদেশ দিতাম।’ (সহিহ বুখারি) এতে দাঁত পরিষ্কার থাকে, মাড়ি মজবুত হয়, পাকস্থলী ভালো থাকে এবং হজমে সাহায্য করে।
ভোরে হাঁটা : ভোরের নির্মল পরিবেশে হাঁটা অনেক উপকারী। হজরত রাসুল (সা.) হজরত আসলাম (রা.)-কে বলেন, ‘হে আসলাম! তুমি বের হও, বাতাসে শ্বাস নাও এবং পাহাড়ের চূড়ায় (নির্মল পরিবেশে) আবাস গড়ো।’ (মুসনাদে আহমদ)
মসজিদে নববী থেকে মসজিদে কুবার দূরত্ব প্রায় সোয়া তিন কিলোমিটার। হজরত রাসুল (সা.) মাঝেমধ্যে মসজিদে কুবায় যেতেন। তিনি হেঁটে ও আরোহণ করে সেখানে যেতেন এবং দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। (সুনানে নাসায়ি) সকালের নির্মল বাতাসে হাঁটলে শরীরে অক্সিজেন প্রবাহ বাড়ে, হজম ও হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটা মস্তিষ্কের জন্য উপকারী। সকালের রোদ ভিটামিন ডি-এর অভাব দূর করে।
দুপুরে খাবারের পর বিশ্রাম : দুপুরের খাবার গ্রহণের পর সামান্য বিশ্রাম গ্রহণ করা স্বাস্থের জন্য খুবই উপকারী একটি বিষয়। হজরত রাসুল (সা.) এটা করতে উৎসাহ দিয়েছেন। সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে জুমার নামাজ আদায় করতাম, এরপর দুপুরের বিশ্রাম করতাম।’ (সহিহ বুখারি) অন্য হাদিসে হজরত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুপুরে কিছুক্ষণ ঘুমাও। কেননা শয়তান দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রাম করে না।’ (মুজামুল আওসাত ২৮) স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা বলেন, দুপুরে অল্প সময় ঘুমালে শরীর ও মন সতেজ হয়। কাজের প্রতি মনোযোগ ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পায়।
ডান পাশ হয়ে ঘুমানো : হজরত রাসুল (সা.) ডান পাশ হয়ে ঘুমাতেন এবং অন্যদেরও ডান পাশ হয়ে ঘুমাতে উৎসাহিত করতেন। হজরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি যখন বিছানায় যাবে, তখন নামাজের অজুর মতো অজু করে নেবে এবং তোমার ডান কাতে শোবে।’ (সহিহ বুখারি) ডান কাত হয়ে ঘুমালে হৃৎপিণ্ড ও পাকস্থলীর ওপর চাপ কমে, এসিড রিফ্লেক্স কমে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের উন্নতি ঘটে। তবে গর্ভবতী নারীর জন্য বাঁ কাত হয়ে ঘুমানো বেশি উপকারী।
জায়তুন তেল ব্যবহার করা : হজরত রাসুল (সা.) চুলে ও শরীরে নিয়মিত তেল ব্যবহার করতেন। তিনি জায়তুন (অলিভ অয়েল) ব্যবহারে উৎসাহ দিয়েছেন। হজরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা জয়তুন তেল খাও এবং তা শরীরে মালিশ করো। কেননা তা বরকতময় গাছ থেকে আসে।’ (জামে তিরমিজি) এই তেল ত্বক মসৃণ রাখে, চুলে পুষ্টি জোগায় এবং রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
বসে পান করা : হজরত রাসুল (সা.) বসে পানাহার করতে বলেছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘হজরত রাসুল (সা.) দাঁড়িয়ে পান করতে নিষেধ করেছেন।’ (সহিহ মুসলিম) বসে পান করলে পানি ধীরে ধীরে শরীরে প্রবেশ করে। এতে শরীরের কোষগুলো ঠিকমতো পানি গ্রহণ করতে পারে এবং পানি অধিক পরিমাণ ক্ষতিকর পদার্থ নিয়ে বের হয়ে যায়। বিপরীতে দাঁড়িয়ে পানি পান করলে কিডনি, পাকস্থলী ও শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
হাঁচির সময় রুমাল ব্যবহার করা : হজরত রাসুল (সা.) হাঁচির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘যখন হাঁচি আসত তখন হজরত রাসুল (সা.) হাত বা কাপড় দিয়ে মুখ বন্ধ রাখতেন এবং হাঁচির শব্দ নিচু করতেন।’ (আবু দাউদ) হাঁচির মাধ্যমে রোগ-জীবাণু ছড়ায়। তাই এ সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখলে অন্যরা ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা : ইসলাম নির্ধারিত সময়ের বিরতিতে নখ কাটা, মোচ কাটা ও শরীরের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করার নির্দেশ দিয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘পাঁচটি বিষয় মানুষের ফিতরাতের (সহজাত প্রকৃতি) অন্তর্গত। খাতনা করা, নাভির নিম্নভাগের লোম চেঁছে ফেলা, গোঁফ ছাঁটা, নখ কাটা এবং বগলের পশম উপড়ে ফেলা।’ (সুনানে নাসায়ি) এগুলোর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার রোধ হয় এবং এগুলো ত্বক, চোখ, মুখ ও দেহের রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
হজরত রাসুল (সা.)-এর সুন্নত শুধু ইবাদতের অংশ নয়, বরং সুস্থ ও পরিপাটি জীবনযাপনের পথও দেখায়। হাত ধোয়া থেকে শুরু করে খাবার গ্রহণে সংযম, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, হাঁটা, বিশ্রাম, সঠিক ভঙ্গিতে ঘুমানো, এই সবই আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে আজ পরীক্ষিত ও স্বীকৃত। তার প্রতিটি আচরণে রয়েছে মানুষের কল্যাণ। তাই আমাদের উচিত দৈনন্দিন জীবনে এসব সুন্নত বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজেকে সুস্থ রাখা এবং সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখা।
লেখক : শিক্ষক ও প্রবন্ধকার
ভয়েস/আআ/সূত্র:দেশরূপান্তর