বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:২৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ভ্যাপসা করোনাকাল

পাভেল পার্থ:

দেশ-দুনিয়ায় তাপ বাড়ছে। এ নিয়ে ২০১০ সালে গরমের পাবলিক অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা সমীক্ষা করেছিলাম। কতভাবে মানুষ গরমকে শ্রেণিকরণ করে? ‘কাঠফাটা গরম’, ‘বিশ্রী গরম’, ‘প্রচ- গরম’, ‘অস্বস্তিকর গরম’, ‘বেহুদা গরম’, ‘অহেতুক গরম’, ‘দমবন্ধ গরম’, ‘তালপাকা গরম’, ‘চান্দিফাটা গরম’, ‘অসহ্য গরম’, ‘দমবন্ধ গরম’, ‘মাথা গরম’, ‘হাঁফসানি গরম’। এর ভেতর সবচেয়ে বেশি মানুষ বলেছিল, ‘ভ্যাপসা গরম’। করোনাকালে আবার সেই ভ্যাপসা গরম ফিরে এসেছে, তবে গত চল্লিশ বছরে ভরা শ্রাবণে এমন গরম আগে দেখা যায়নি। তবে ভাদ্রের গরম ভিন্ন কথা। ‘তাল পাকা গরমের কাল ভাদ্র’। আবহাওয়াবিজ্ঞান জানাচ্ছে, দিনের দৈর্ঘ্য বেশি থাকায় সূর্যের প্রখর আলো মাটির পিঠে বেশি সময় ধরে পড়ছে তাই গরমের স্থায়িত্বও বেশি হচ্ছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ভেতর পার্থক্য কম, বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি তাই যতটা তাপমাত্রা তারচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে। এই ভ্যাপসা গরম নাকি চলতে পারে সেপ্টেম্বর অবধি। এই গরমে শিশু-প্রবীণ-প্রসূতিরা আছেন এক নিদারুণ কষ্টে। ছটফট করছে বৃক্ষলতা-পাখপাখালির প্রাণ। ভ্যাপসা গরমে জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ, ক্লান্তি, পানিশূন্যতা, ডায়রিয়া, চর্মরোগ হচ্ছে অনেকের। আরেকদিকে দেশের অনেক মানুষ পানিবন্দি। বন্যাতেও ডায়রিয়া, জ্বর, কাশি, চর্মরোগ ছড়াচ্ছে। সমস্যা হলো এইসব উপসর্গ প্রায় সবই করোনা সংক্রমণেরও উপসর্গ। ভ্যাপসা গরম, বন্যা আর করোনা সবকিছু মিলে আরেক শঙ্কা আর বিপদ তৈরি হচ্ছে পাবলিক পরিসরে। বিদীর্ণ জীবন আর বিদীর্ণ মন। কত আর সয় এক জীবনে, এক শরীরে, এক কলিজায়।

ভ্যাপসা পাতা, ভ্যাপসা পর্র্দা : চারদিকে কেবল লুটপাট, দোষারোপ আর নির্দয় মুনাফাভোগের সংবাদ। গণমাধ্যম জুড়ে কেবল প্রতারক আর লুটেরাদের বিশাল কাহিনী। পাতায় পাতায় ‘অপরাধীর’ ছবি। যেন ‘অপরাধ’ করাই মানুষের কাজ। করোনাকালে ঘরবন্দি শিশুদের কানে আর চোখে এসব বিশৃঙ্খল দৃশ্য ছাড়া আর কোনো ইশারা নেই। চারপাশে এত ‘যন্ত্রণা’ আর ‘দোষ’ ছড়িয়ে শিশুদের জন্য কেমন একটা সময় গড়ে তুলছি আমরা? একটাও কি আশার খবর নেই এই মায়াময় দেশে? মহামারীর প্রথম দিকে জানবাজি রেখে বোরো মৌসুমের ধান আমাদের থালায় নিশ্চিত করলেন গ্রামবাংলার কৃষক। পাতা কি পর্দাজুড়ে আমরা সেই কৃষকের ছবি দেখিনি। ক্ষমাহীন জালিয়াতির পরও নিদারুণভাবে গণমাধ্যমজুড়ে রিজেন্টের সাহেদের ছবি। এই যে গ্রামবাংলার নারীরা এমন করোনা সংকটেও হাত পাতেননি কারও কাছে, চারধার থেকে শাক লতা কুড়িয়ে জোগাড় করলেন পরিবারের পুষ্টি। গ্রামীণ নারীর এই খাদ্যযুদ্ধের কাহিনী কোথায়? অথচ পাতায় পাতায় জেকেজির অপরাধী ডা. সাবরিনা কিংবা ঢাবি’র সহকারী রেজিস্ট্রার শারমিন। করোনাকালেই সুপার সাইক্লোন আম্পানে লন্ডভন্ড হলো উপকূল। বাঁধগুলো ভাঙল, তলিয়ে গেল বসত লবণজলে। মানুষ তো দাঁড়িয়েছে আবার। দুনিয়ার ইতিহাসে এই প্রথম মহামারী ও ঘূর্ণিঝড় একসঙ্গে মোকাবিলা। কীভাবে করল একটা ‘গরিব দেশের’ মানুষ? এই মোকাবিলার গল্প পাতায় পাতায় ছাপা হলে দুনিয়া আরও সাহস পেত। ধার পেত কলিজায়। শেরপুরের ‘ভিক্ষুক’ নাজিম উদ্দীন ভিক্ষার সঞ্চয় করোনা সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে দান করেছেন। রংপুরের ‘জুতা কারিগর’ মিলন রবিদাসও পনের বছরের সঞ্চয় করোনা সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে দান করেছেন। স্বাধীন দেশের কথা ছিল আমাদের গণমাধ্যমে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে’। ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ নিয়ে শহুরে এলিটদের কিছু তর্ক জারি আছে যেখানে দেশের নিম্নবর্গের ‘মতপ্রকাশ’ নিয়ে কোনো উচ্চারণ কখনোই উছলে ওঠেনি। কথা ছিল স্বাধীন গণমাধ্যমের পাতা কি পর্দাজুড়ে থাকবে নাজিম উদ্দীন বা মিলন রবিদাসদের ছবি। সাহেদ, সাবরিনা বা শারমিন নয়। এমনকি ‘আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই’ বলে শোরগোল তোলা সুবিধাভোগী এলিট শ্রেণিরও নয়। করোনাকাল আবারও নিদারুণভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে ‘গণমাধ্যম’ থেকে ‘গণপরিসর’ সবই সমাজের অধিকতর সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির বলয়েই বন্দি। এ বলয়ের বদল জরুরি। তাহলে পাতা কি পর্দা কিছুটা হলেও নিম্নবর্গের হয়ে উঠবে। যেখানে টাটকা সাহস, কারিগরি, বিজ্ঞান, কলা ও সৃজনশীলতা আছে। আমাদের শিশুরা তাহলে নাজিম কি মিলনের কীর্তির ছাপেই চিনতে শিখবে এক মায়াময় বাংলাদেশ। আহা মহামারীকালেও কত আশার ঝলকানি, কত ঝঞ্ঝামুখর রাতদিন। আলাপ শুরু করেছিলাম ভ্যাপসা গরম নিয়ে। কেবল আবহাওয়াগত কারণে নয়, আমাদের চারপাশের পাতা ও পর্দাজুড়েই আজ ভ্যাপসা গরম। আবহাওয়া বদলে যাবে, যায়। কিন্তু পাতা ও পর্দায় বদল না ঘটলে ভ্যাপসা মন ও মগজের জটিল অসুখ কে সারাবে?

টিকে থাকার বিজ্ঞান : বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রবাদ বা বচনকে স্থানীয় মুন্ডা আদিবাসীরা ফষ্ঠি বলেন। আমে ধান, তেঁতুলে বান কিংবা ব্যাঙ ডাকলে বর্ষা হবে আর শিয়াল বেশি ডাকলে খরা হবে বলে তারা মনে করেন। আগে বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠ খুব গরম ছিল, আষাঢ়ে ছিল সহ্য করার মতো গরম, কিন্তু ভাদ্রে ছিল তালপাকা গরম। স্থানীয়দের মতে, আম-জাম-তাল পেকে গেলে গরম বাড়ে তখন পুরো বরেন্দ্র এলাকায় ‘নিন্দ লাগা থায়’ অবস্থা সৃষ্টি হয়। মানুষ দিনের বেলা দুপুরে মাঠে কাজ করতে পারে না, বাড়িতেই বসে থাকতে হয়। শরীরে একটা ঢুলুঢুলু অবশ ভাব চলে আসে। কিন্তু সেই গরমকাল এখন কমে গেছে। এছাড়াও ছিল পইচ্ছ্যা-ঝাটি। চৈত্র মাসে পইচ্ছ্যা-ঝাটি নামে গরম বাতাস বইত বরেন্দ্রভূমিতে। লাহিরবেলা (সকাল) থেকে দুপুর পর্যন্ত এই গরম বাতাস বইত। সাইনঝর (সন্ধ্যা) পর থেকে গরম কমে গিয়ে আবার পুরো এলাকা ঠান্ডা হয়ে আসত। পইচ্ছ্যা-ঝাটি খুব ক্ষতি করত ফসলের, গাছপালার। সব জ্বলেপুড়ে যেত। কিন্তু প্রায় তিরিশ বছর যাবৎ পইচ্ছ্যা-ঝাটি একেবারেই বিদায় নিয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে সুরক্ষার জন্য মাটির ঘরের দেয়ালগুলো চৈত্র মাসেই লেপা হয়। লাল, সাদা, কালো, হলুদ রঙের মাটি এবং দেয়ালগাত্রের নকশা এবং লেপন পদ্ধতি এক্ষেত্রে গরম আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কাজ করে। তাপপ্রবাহ থেকে সুরক্ষার জন্য এ সময়টাতে বরেন্দ্র অঞ্চলে খুব বেশি তেঁতুল পাতার টক ও ঝোল জাতীয় খাবার খাওয়া হয়। গম ও যবের ছাতু আখের গুড় দিয়ে মেখে খাওয়া হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামে তেঁতুল ও নিমগাছের সারি তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে সুরক্ষার জন্যই। বাংলাদেশের সর্বাধিক শীতলতম ও বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। শ্রীমঙ্গলের বনটিলার খাসি জনগোষ্ঠী ভ্যাপসা গরমে সাধারণত ডুমুর, ফার্ণ জাতীয় শাক ও বৃক্ষজাতীয় শাকের কচি ডগা বেশি খেয়ে থাকেন। হাওরাঞ্চলে গরম থেকে রক্ষায় সকালবেলা বরুণ গাছের কচি ডগা বা বেত গাছের ডগার ‘ঝোরা (ভর্তা)’ করা হয়। খুদের জাউয়ের ভেতর পাট শাক বা কাটাখুদরি শাক দিয়ে রান্না করা হয়। হিদল শুঁটকি ও কচুর লতি দিয়ে পাতলা ঝোল রান্না করা হয়। করোনাকালের এই ভ্যাপসা গরমে বেশি পানি ও তরল খাবার খাওয়া দরকার। টক ও তেতো স্বাদের খাবার। করলা, গিমা, থানকুনি, নিম, কলমি, হেলেঞ্চা, কচু এসব শরীর ঠান্ডা রাখে। হজমে সহায়তা করে। টক দই, মাঠা, ঘোল খাওয়া যায়। অতিরিক্ত মসলা ও তেল-চর্বিহীন পাতলা ঝোল খাবারই এ সময়ের পথ্য। ঘেমে গেলে শরীর মুছে ফেলা, প্রবীণ ও শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর রাখা। আদা, লেবু, লবঙ্গ, দারুচিনি, গোলমরিচ, বচ, কালোজিরা, মধু, রসুন, হলুদ, অশ্বগন্ধা, যষ্টিমধুর নিয়মানুযায়ী ব্যবহার সহায়ক। ঈষদুষ্ণ ভেষজ চা, গরগরা কিংবা গরম জলের ভাপও অনেক কাজে দেয়। কারণ এই গরমে তৈরি নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যা করোনা সংক্রমণের উপসর্গের সঙ্গেও যে মিলে যায়।

শরীর বাঁচাচ্ছি, কিন্তু মনের জমিন? : আলাপের শুরুতে ভ্যাপসা গরমের সঙ্গে পানিবন্দি বন্যাও আছে। মৌসুমি বন্যা তো বদ্বীপের এক মুখস্থ ব্যাকরণ। কিন্তু উজানে ঢল আর ভাটিতে সব পথ-প্রণালী বন্ধ হয়ে পানিবন্দি পরিস্থিতি এক বেসামাল বাস্তবতা। অপরিণামদর্শী উন্নয়নের ফলে বন্যার সঙ্গে দীর্ঘ জলাবদ্ধতা যেমন রোগের বিস্তার ঘটায়, আবার দীর্ঘ পানিবন্দি পরিস্থিতি মনের জমিনও বদলে দেয়। মানুষ খেই হারিয়ে ফেলে, একের পর এক স্খলিত হতে থাকে আশার দানাবিন্দু। কেবল ত্রাণ আর বন্যা-পরবর্তী সহযোগিতা নয়; করোনাকালে বন্যা বিষয়ে আমাদের একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় আসা জরুরি। নদী আর জলাভূমি খুন-ধর্ষণ-লুণ্ঠনের অধ্যায় করোনাতেই থেমে যাক। করোনা-উত্তর শুরু হোক নদীর আরেক ‘নয়া স্বাভাবিকতার জীবনস্রোত’। বর্ষা আর বন্যা এলেই দেশে একের পর এক শিশুরা পানিতে ডুবে মরে কেন? পানির দেশে এ কেমন ‘আধুনিক নিষ্ঠুর শৈশব’? কেমন শিক্ষাপদ্ধতি আর বিদ্যায়তন আমাদের? এমন শিক্ষাজীবন দিয়ে কী লাভ? বিদ্যালয়ে গেলাম আর কিছু বই মুখস্থ করলাম কিন্তু সাঁতারটাই জানলাম না। তাহলে জীবনে বাঁচার জন্য সাঁতার, গাছে চড়া, দৌড়, বাগান কিংবা ফেলনা জিনিসের পুনঃব্যবহার এসব শিক্ষা প্রাথমিক বিদ্যালয়েই যুক্ত করা জরুরি। নাকি আমরা শিশুদের বড় করে তুলব একজন ক্ষমতাবান নদীদখলকারী বা নদীবিমুখ এক করপোরেট প্রকৌশলী হিসেবে? আমরা কি ভ্যাপসা গরম থেকে রেহাই পেতে শিশুদের জগৎবন্দি করে রাখব মুভেনপিকের আইসক্রিম আর বহুজাতিক এসি কোম্পানির বিশৃঙ্খল বাস্তবতায়?

পাঁচ শনি, পাঁচ রবি, পাঁচ সোম : বর্ষপঞ্জির ইতিহাসে করোনাকালের আগস্ট মাস খুব ব্যতিক্রম। এ মাসে ৫ শনি, রবি ও সোমবার। প্রায় আটশ বছরের বেশি সময় পরপর এমন হয়। মহামতি খনার এক বচনে আছে, পাঁচ রবি মাসে পায় ঝরায় কিংবা খরায় যায়। গেল শ্রাবণ ঝরা আর গরমের তীব্রতা নিয়েই ছিল, ভাদ্রেও এর রেশ আছে। রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন, এই শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে। এই আগুন আমাদের মায়াময় দেশ-দুনিয়াকে দেখার চোখ তৈরি করুক। আমাদের পাতা ও পর্দা বদলে যাক। নতুন প্রজন্মের ভেতর পরিবর্তনের যাতনা আছে। আগুন আছে। মুনাফা, ভোগ, লুণ্ঠন, দখল বা কেলেঙ্কারি নয়; ইতিহাসের নায়ক নাজিম উদ্দীন কি মিলন রবিদাস। এই মাটির অনেক বলা-না বলা গল্প আছে। গাঁথুনি আছে। এই গল্প-গাঁথুনি নিয়েই দাঁড়াক নতুন প্রজন্ম, চারধারের সব বিশৃঙ্খল দৃশ্য চুরমার করে। এভাবেই কাটবে ভ্যাপসা গরম, বন্যা কি করোনাকালের সংকট।

লেখক গবেষক ও লেখক

animistbangla@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION