বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:২৩ অপরাহ্ন
রায়হান আরা জামান:
করোনা-বাস্তবতায় কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইন ক্লাস চলছে, চলছে অনলাইন ক্লাস-সংক্রান্ত নানামাত্রিক আলোচনাও। সেই আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ডিভাইস আছে কী নেই, পর্যাপ্ত মোবাইল নেটওয়ার্ক ও গতি, বিভিন্ন অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন যেমন জুম, গুগল মিট, গুগল ক্লাসরুম প্রভৃতির ব্যবহার ইত্যাদি। অর্থাৎ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার হার্ডওয়্যার অ্যাপ্রোচ আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। মনে রাখা দরকার, মুখোমুখি ক্লাসে শিক্ষক যেভাবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তথ্যবিনিময় করেন বা আলোচনা করেন অনলাইন ক্লাসে ঠিক সেভাবে সম্ভব হয় না। অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার অর্থ কি শুধু কোনো ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া? যদি তা-ই হয়, তাহলে টেলিভিশন বা রেডিওর ক্লাস বা অন্যান্য অনলাইন ক্লাস কেন যথেষ্ট কার্যকর হচ্ছে না! ‘শিক্ষক কীভাবে পড়াবেন’ অনলাইন শিক্ষণের এই সফটওয়্যার অ্যাপ্রোচটিও সমান মনোযোগ পেলে অনলাইন ক্লাস তুলনামূলক বেশি কার্যকর হবে বলে ধারণা করা যায়।
অনলাইন ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ‘সিনক্রোনাস’ অথবা ‘অ্যাসিনক্রোনাস’ পদ্ধতির যেকোনো একটি উপায়ে সংযুক্ত হতে পারেন। সিনক্রোনাস লার্নিং কথাটার অর্থ শিক্ষক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে নেন এবং সে সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই অনলাইনে হাজির হন। এই উপায়ে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেকখানি মুখোমুখি ক্লাসের মতো আলোচনা সম্ভব। তবে এই পদ্ধতিতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, শক্তিশালী নেটওয়ার্ক, উপযুক্ত ডিভাইস ও পড়ার আলাদা জায়গা থাকা প্রয়োজন; আমাদের দেশের বাস্তবতায় অনেক ক্ষেত্রে যা সম্ভব নয়। অ্যাসিনক্রোনাস-পদ্ধতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর একই সময়ে অনলাইনে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না; এখানে শিক্ষক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সব ধরনের শিখন উপকরণ উপস্থাপন করেন। যেমন শিক্ষক গুগল ক্লাসরুম, মুকস (MOOCS), ইউটিউব চ্যানেল বা অন্য কোনো ডকুমেন্ট শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ই-বুক, পিডিএফ, ডকুমেন্ট, অডিও, ভিডিও বা টিউটোরিয়াল শেয়ার করতে পারেন। শিক্ষার্থী তার ইচ্ছেমতো সময়ে সেসব শিখন উপকরণ ব্যবহার করে শিখতে পারে।
একজন শিক্ষক হিসেবে আপনি সিনক্রোনাস ও অ্যাসিনক্রোনাস-পদ্ধতির কোন পদ্ধতি ব্যবহার করবেন? শিক্ষার্থীর সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ পরিবেশ তৈরি করে তাদের বর্তমান অবস্থা এবং চাহিদা বুঝে ওই শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি বাছাই করা যায়। শিক্ষার্থীর চাহিদা, শেখার আগ্রহ ও তাদের সামগ্রিক অবস্থা বোঝার জন্য কিছু প্রশ্ন করা যেতে পারে। যেমন তোমার বাসায় কি কম্পিউটার/ল্যাপটপ/স্মার্টফোন আছে? তোমার মতো তোমার ভাই-বোনরাও কি এই ডিভাইস ব্যবহার করে? তোমার কি পড়ালেখার জন্য আলাদা জায়গা আছে? ইত্যাদি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিনক্রোনাস ও অ্যাসিনক্রোনাস-পদ্ধতির একটি যৌক্তিক মিশ্রণ বেশ কার্যকর। সপ্তাহে এক দিন সিনক্রোনাস পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে এসে সপ্তাহব্যাপী অ্যাসিনক্রোনাস-পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের শিখন উপকরণ সরবরাহ করা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর বারাক রোসেনসাইন সারাজীবন কার্যকর শিখন, শিক্ষকের কাজ ও শিক্ষার্থীর শিখন অর্জন নিয়ে কাজ করেছেন। ‘নির্দেশনার মূলনীতি’ নামক তার বিখ্যাততত্ত্বে তিনি সব প্রেক্ষাপট এবং সব বিষয়ের জন্য প্রযোজ্য শিক্ষণের দশটি কৌশলের কথা বলেছেন যাতে ক্লাস প্রকৃত অর্থে কার্যকর হতে পারে। বিশ্বব্যাপী করোনাকালীন পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা যখন আরও গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে, তখন মার্ক এন্সার দেখিয়েছেন রোজেনাসাইনের এই শিক্ষণ মূলনীতিগুলো অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তিনি ‘Coronavirus : a 5-point model to deliver online learning’ নামক আলোচনায় রোজেনসাইনের মূলনীতিগুলোকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে অনলাইন ক্লাসের জন্য পাঁচটি মূলনীতির মডেল তৈরি করেছেন, যা ব্যবহার করে আমাদের দেশের সব স্তরের অনলাইন ক্লাসকে আরও প্রাণবন্ত এবং কার্যকর করা সম্ভব।
মার্ক এন্সারের পাঁচ পয়েন্ট মডেলের প্রথম পয়েন্টে বলা হয়েছে, অনলাইন ক্লাসে নতুন বিষয় আলোচনা শুরু করার আগে মুখোমুখি ক্লাসে যা আলোচনা হয়েছিল, পুরনো সেসব পাঠ আবার আলোচনা করে নিতে হবে। এতে আগে শেখা বিষয় যা চর্চার অভাবে শিক্ষার্থীরা ভুলতে শুরু করেছে, সেগুলোর সঙ্গে আবার তারা সংযোগ স্থাপন করতে পারবে এবং সে বিষয়গুলো ভবিষ্যতে আরও স্থায়ীভাবে মনে রাখতে পারবে। নানাভাবে পুরনো পাঠ সম্পর্কে আলোচনা করা যায় : শিক্ষক আগে আলোচনা করা বিষয় থেকে প্রশ্ন করতে পারেন, কোনো মডেল বা ছবি দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের বোধগম্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন অথবা শুধু তাদের যা মনে আছে, সে বিষয়ে তাদের আলোচনা করতে বলতে পারেন।
মডেলের দ্বিতীয় পয়েন্টে এন্সার বলেছেন, অনলাইনে একই বিষয়ে একসঙ্গে শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি তথ্য দিলে তা শিক্ষার্থীদের বিরক্তির ও মনোযোগহীনতার কারণ হতে পারে। তাই আলোচ্য বিষয়কে কতকগুলো ভাগে ভাগ করে এক-একটি অংশ নিয়ে কথা বললে বা তথ্য দিলে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও মনোযোগ থাকবে। তারপর আলোচিত ক্ষুদ্র অংশের ওপর কোনো কাজ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিষয়টি অনুশীলনের সুযোগ দিতে হবে (রিপোর্ট লেখা, প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, পোস্টার তৈরি করা প্রভৃতি)। এরপর নতুন অংশ নিয়ে কাজ শুরু করা যেতে পারে।
শিক্ষার্থীদের বোধগম্যতা যাচাই করার জন্য প্রচুর প্রশ্ন করা এবং উত্তরের ফিডব্যাক দিয়ে তাদের শিখন অর্জন বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টাকে এন্সার মডেলের তৃতীয় পয়েন্ট হিসেবে রেখেছেন। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে শিক্ষার্থীদের মুখ ও শরীরের ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করা বেশ কঠিন বলে তিনি প্রশ্ন করে শিক্ষার্থীর বোধগম্যতা যাচাই করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এজন্য গুগল ফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে, তাতে সিনক্রোনাস ও অ্যাসিনক্রোনাস দুভাবেই শিক্ষার্থীদের শিখন যাচাই করা সম্ভব হবে। শ্রেণিকক্ষে বোর্ড ব্যবহার করা, মডেল দেখানো, দলীয় কাজের মাধ্যমে সমস্যা-সমাধানমূলক পদ্ধতিতে কাজের সুযোগ দেওয়া একটি সাধারণ বিষয়। কিন্তু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এই বিষয়গুলো একটি নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করছে, যদিও শিখনের জন্য এ কাজগুলো খুব জরুরি। এন্সার মডেলের চতুর্থ পয়েন্টে বলেছেন, শিক্ষক যদি আগে থেকেই মডেল বা ছবিসংবলিত স্লাইস তৈরি করে রাখেন অথবা ভার্চুয়াল হোয়াইট বোর্ড ব্যবহার করেন, তবে এ সমস্যা অনেকাংশে কমে আসবে। সিনক্রোনাস ক্লাসে দলীয় কাজও দেওয়া যেতে পারে, কাজের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি-সংবলিত একটি স্লাইস তৈরি করে রাখলেই নির্দেশনা দিতে আর সমস্যা হবে না।
এন্সারের শেষ পয়েন্টে পাঠের পুনরালোচনা করার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি বলেছেন, অনেক সময় সিলেবাস শেষ করার ব্যস্ততায় শিক্ষকরা পাঠের পুনরালোচনা করেন না। কিন্তু অনলাইন ক্লাসেও সাপ্তাহিক ও মাসিক পুনরালোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে শিক্ষার্থীরা পাঠ সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা পায় এবং প্রতিটি অংশের মধ্যে সম্পর্ক ও পার্থক্যগুলো বুঝতে পারে। অনলাইন ক্লাসের জন্যও শিক্ষকের প্রস্তুতি প্রয়োজন। অনলাইন ক্লাসের শিক্ষণপদ্ধতি সম্পর্কে ফ্রি অনলাইন কোর্স তৈরি করে বাংলাদেশের অনলাইন কোর্সবিষয়ক ওয়েবসাইট মুক্তপাঠ এবং এ ধরনের অন্য ওয়েবসাইটে আপলোড করা যেতে পারে। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ওয়েবসাইটে এ ধরনের ফ্রি অনলাইন কোর্স আপলোড করেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এমন পদক্ষেপ নিতে পারে। অনলাইন শিক্ষাকে আমি শুধু পরিস্থিতির কারণে বিকল্প পাঠদান মাধ্যম হিসেবে দেখতে চাই না। বরং গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষার একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে দেখতে চাই। তাই অনলাইন শিক্ষণকে টেকসই ও কার্যকর করতে অনলাইন শিক্ষণের হার্ডওয়্যার-সফটওয়্যারের পাশাপাশি পাঠদানপদ্ধতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।
লেখক : প্রভাষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
shilu.2003@gmail.com