শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১২ পূর্বাহ্ন
সাইফুল ইসলাম:
আল্লাহতায়ালা মানুষকে সব প্রাণী থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষকে দান করেছেন বিবেক-বুদ্ধি, বিবেচনা ও চিন্তাশক্তি। যেন সে ভালো-মন্দ বিবেচনা করে মহান আল্লাহর নির্দেশিত পথে স্থির থাকে এবং সব ধরনের অন্যায়-অত্যাচার ও জুলুম-নির্যাতন থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে। এরপরও মানুষ যখন সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ের পথে অগ্রসর হয় তখন সীমালঙ্ঘনকারীকে বিচারের মুখোমুখি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)-এর সময়ে নিয়মতান্ত্রিক কোনো কারাগার এবং কোনো ব্যক্তিকে বন্দি রাখার স্থান ছিল না। তাছাড়া তৎকালীন কোনো ব্যক্তিকে বন্দি করার খুব বেশি প্রয়োজনও ছিল না। তখন কাউকে বন্দি করার খুব বেশি প্রয়োজন হলে তাকে মসজিদে বা মসজিদের আঙিনায় বেঁধে রাখা হতো। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর সময়ে তিনিই সর্বপ্রথম স্থায়ী কারাগার তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররামায় হজরত ওমর (রা.) চার হাজার দিরহামের বিনিময়ে একটি জায়গা খরিদ করে সেখানে একটি কারাগার নির্মাণ করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া) কিছু ঐতিহাসিকের মতে, হজরত ওমর ও উসমান (রা.)-এর যুগেও কোনো স্থায়ী কারাগার তৈরি করা হয়নি; বরং হজরত আলী (রা.) তার খেলাফতের সময় সর্বপ্রথম কারাগার নির্মাণ করেন। ইবনে হুমাম (৭৯০-৮৬১) তার কালজয়ী গ্রন্থ ফাতহুল কাদিরে উল্লেখ করেন, ‘হজরত আলী (রা.) সর্বপ্রথম বাঁশের তৈরি কারাগার নির্মাণ করেন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর এতে আটক থাকা কিছু চোর সিঁধ কেটে পালিয়ে যায়। তারপর তিনি শক্ত মাটিতে ঢালাই দিয়ে আগের থেকে আরও মজবুত করে আরেকটি কারাগার নির্মাণ করেন।
শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য : ইসলামে অপরাধীকে শাস্তি প্রদানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো অপরাধী মানুষকে সংশোধনের মাধ্যমে অপরাধের বিস্তার রোধ করা এবং ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই হিসেবে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যথাযথ কারণে কাউকে বন্দি বা কারারুদ্ধ করে রাখা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করারই একটি ধারাবাহিকতা। তবে অপরাধী হলেও কারাবন্দিদের সঙ্গে ইসলাম মানবিক আচরণ করার নির্দেশ দেয়।
ন্যায়বিচার করা : হজরত দাউদ (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে দাউদ! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছি। সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে যথাযথভাবে বিচারকার্য করো।’ (সুরা সোয়াদ ২৬)
বদরের যুদ্ধে অনেক কাফের মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। হজরত রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা বন্দিদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো। অতঃপর আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর এই নির্দেশের পর মুসলমানরা রুটি না খেয়ে শুধু খেজুর খেয়ে ওই রুটি বন্দিদের খেতে দিয়েছিলেন। (আল ওয়াকিদি)
আল্লাহ ন্যায়বিচারকের সাহায্যকারী : হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘হজরত রাসুল (সা.) আমাকে ইয়েমেনের বিচারক হিসেবে প্রেরণ করেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাকে ইয়েমেনের বিচারক হিসেবে পাঠাচ্ছেন, অথচ আমি একজন যুবক। আর বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা নেই। তিনি বলেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমার অন্তরকে সঠিক সিদ্ধান্তের দিকে পথ দেখাবেন এবং তোমাকে প্রতিষ্ঠিত রাখবেন। যখন তোমার কাছে মানুষ বিচার-ফয়সালার জন্য আসবে তখন তুমি যেভাবে একপক্ষের বক্তব্য শুনবে তেমনি অন্যপক্ষের বক্তব্য না শোনা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেবে না। এতে তোমার সামনে মোকদ্দমার আসল সত্য প্রকাশিত হবে। আলী (রা.) বলেন, অতঃপর আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সন্দেহে পতিত হয়নি।’
সত্য জেনে ফয়সালাকারী জান্নাতি : ইবনে বুরাইদাহ তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেছেন, হজরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকার বিচারক জান্নাতি এবং অন্য দুই প্রকার বিচারক জাহান্নামি। জান্নাতি বিচারক হলো, যে সত্যকে বুঝে ফয়সালা দেয়। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পরও স্বীয় বিচারে জুলুম করে সে জাহান্নামি এবং যে বিচারক অজ্ঞতাপ্রসূত ফয়সালা দেয় সেও জাহান্নামি।’
ন্যায়পরায়ণ শাসকের মর্যাদা : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে দিন মহান আল্লাহর রহমতের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না সেই দিন (কেয়ামতের দিন) মহান আল্লাহ সাত ব্যক্তিকে আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। সেই সাত ব্যক্তির মধ্যে এক ব্যক্তি হলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক।’
ইনসাফের নিয়তে বিচার : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বিচারক যখন তার বিচারকার্য করে এবং আলোচ্য বিষয়ে চূড়ান্ত প্রয়াস পায়, অতঃপর যদি তার রায় সঠিক হয় তবে তার জন্য থাকবে দুটি সওয়াব। আর যদি সে বিচারে ভুল করে তবে তার জন্য থাকবে একটি সওয়াব।’
ন্যায়বিচার না করার কারণে পৃথিবীতে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। ন্যায়ের বিধান সর্বকালের এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য সমান। সব আসমানি কিতাবেও এই নির্দেশনা রয়েছে। হজরত রাসুল (সা.) নিজেও আজীবন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমনকি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
ভয়েস/আআ