রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১১:২৬ অপরাহ্ন
মাওলানা মনিরুজ্জামান:
অবিভক্ত ভারতের খ্যাতনামা মুসলিম কবি মুহাম্মদ ইকবাল। একাধারে তিনি ছিলেন দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও ব্যারিস্টার। তার ফার্সি ও উর্দু কবিতাকে আধুনিক যুগের ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাকে পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তিনি ইসলামি রাজনৈতিক দর্শনের জন্যও মুসলিম বিশ্বে বিশেষভাবে সমাদৃত। তাকে ‘আল্লামা ইকবাল’ হিসেবেও সম্বোধন করা হয়। আল্লামা ইকবাল ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইরান ও অন্যান্য দেশে বিশিষ্ট সাহিত্যিক হিসেবে প্রশংসিত। তার জীবনের অন্যতম ঘটনা ছিল স্পেনের কর্ডোবা মসজিদ বন্ধ হওয়ার ৭০০ বছর পর সেখানে আজান দেওয়া ও নামাজ পড়া।
আল্লামা ইকবালের কাব্যজীবনের সূচনা গতানুগতিক ধারার কবিতা দিয়ে শুরু হলেও পরিণত সময়ে তিনি কবিতার উপাদান হিসেবে পবিত্র কোরআন ও হাদিসকে গ্রহণ করেন। ছোট থেকেই কোরআন চর্চা শুরু করেন। ছোটবেলায় তিনি নিয়মিত ও গভীর মনোযোগ দিয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতেন। একদা তার পিতা বলেছিলেন, কোরআন তেলাওয়াতের সময় তোমাকে প্রচণ্ড মনোযোগী হতে হবে। তবেই তুমি কোরআনের ওপর যথাযথ আমল করতে সক্ষম হবে। পিতার সেই কথায় কবি ইকবাল অনেক প্রভাবিত হয়েছিলেন।
যখনই তিনি কোরআন তেলাওয়াত করতেন তখন অন্য কোনো কিছুরই তার খবর থাকত না। তিনি যেন কোরআনের অতল গভীরে ডুবে যেতেন। কোরআন তেলাওয়াতের সময় তার দুই চোখ থেকে অবিরাম অশ্রু ঝরত।
ইকবালের সমগ্র সৃষ্টিকর্মের দিকে তাকালে বোঝা যায়, তার বেশিরভাগই তিনি কোরআন থেকে গ্রহণ করেছেন। ইকবালের বেশিরভাগ কবিতায় কোরআনি ভাবধারা ফুটে উঠেছে। তিনি কবিতার মাধ্যমে মুসলমানদের অত্যন্ত সুন্দর ও মনোরম উপায়ে কোরআনের শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন করেছেন। ইকবাল কোরআনের সর্বজনীন বাণীকে তার কবিতায় রূপান্তরিত করেছেন।
ইকবালের অনেক গ্রন্থ এবং বহুসংখ্যক কবিতার শিরোনামও এ কথার সত্যতা প্রমাণ করে। ‘বালে জিবরিল’, ‘জরবে কলিম’ ‘জবুরে আজম’ প্রভৃতিতে কোরআনের প্রভাব বিদ্যমান। ইকবালের রচিত গ্রন্থাবলির নাম ছাড়াও তার প্রবর্তিত ও ব্যবহৃত পরিভাষার প্রতি লক্ষ করলে দেখা যায়, তার বেশিরভাগ লেখার মধ্যে কোরআনের প্রভাব বিদ্যমান। এসব কিছু তিনি কোরআনের পরিভাষা এবং কোরআনে বর্ণিত কাহিনি থেকে গ্রহণ করেছেন।
ইকবাল বৈঠকে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কোরআনের শিক্ষা ও আদর্শ সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করতেন। শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করতেন।
আল্লামা ইকবালের কাব্য-সাধনা পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে পরিপূর্ণ। তার কোরআন চর্চা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সবচেয়ে বড় গবেষণা কাজটি করেছিলেন ড. গোলাম মোস্তফা খান। ইকবাল একাডেমি পাকিস্তান কর্র্তৃক ১৯৭৭ সালে ‘ইকবাল ও কোরআন’ শিরোনামে তার এ কাজ প্রকাশিত হয়।
কবি ইকবাল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা কর্ডোবা মসজিদে নামাজ আদায় করেন, যা স্পেনে মুসলিম সভ্যতার অনন্য নিদর্শন। অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে খলিফা আবদুর রহমান এটির নির্মাণ শুরু করেন। ৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবদুর রহমানের ছেলে খলিফা হিশাম মসজিদটির প্রাথমিক কাজ সমাপ্ত করেন। নবম শতাব্দীতে খলিফা তৃতীয় আবদুর রহমানের তত্ত্বাবধানে পরিপূর্ণভাবে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম শাসকরা স্পেনের ক্ষমতা হারালে মুসলমানদের ইবাদত বন্দেগির জন্য স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় কর্ডোবা মসজিদের দরজা। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের গির্জায় পরিণত হয় মুসলমানদের টানা ৭০০ বছরেরও অধিক সময়ের এই মসজিদটি। মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগির জন্য তাতে কঠোর আইনি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
আজও স্পেনের অন্যতম আকর্ষণ হলো ঐতিহাসিক কর্ডোবা মসজিদ। এ মসজিদই স্পেনকে পৃথিবীর অন্যতম দর্শনীয় দেশের মর্যাদায় সমাসীন করে রেখেছে। আজও ভ্রমণপিপাসুদের কাছে কর্ডোবা পৃথিবীর আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসেবে স্বীকৃত।
মসজিদ নির্মাণের পর থেকে মুসলিমরা এখানে নামাজ আদায় করেছিলেন প্রায় পাঁচশ বছর। এর সুউচ্চ চারকোনা আকৃতির মিনারটি নির্মাণ করেছিলেন খলিফা তৃতীয় আবদুর রাহমান। এক সময় সুন্দর সেই মিনার থেকে ভেসে আসত আজানের ধ্বনি। কিন্তু গির্জায় রূপান্তরিত হওয়ার পর মিনারটিতে অসংখ্য ঘণ্টা লাগানো হয়েছে। বর্তমানে কর্ডোবা মসজিদে জুতা পরিহিত অবস্থায় প্রবেশাধিকার রয়েছে।
স্পেন থেকে মুসলমানরা বিতাড়িত হওয়ার পর দীর্ঘ ৭০০ বছর কর্ডোবা মসজিদে কোনো আজান ও নামাজ হয়নি। আল্লামা ইকবালের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল এই মসজিদে দুই রাকাত নামাজ পড়ার। ১৯৩৩ সালে স্পেন সফরকালে আল্লামা ইকবাল এই মসজিদ পরিদর্শন করেন। মসজিদে নামাজ পড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও শুধু আল্লামা ইকবালকে মসজিদে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে প্রবেশের পর ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিতে বলা হয়। মসজিদে প্রবেশ করেই উচ্চৈঃস্বরে আজান দেন আল্লামা ইকবাল। দীর্ঘ ৭০০ বছর পর ওই মসজিদে এটিই ছিল প্রথম আজান। আজানের পর জায়নামাজ বিছিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন আল্লামা ইকবাল। নামাজের পর এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফেরার পর তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে মুনাজাত করেন।
আল্লামা ইকবালের জীবনের প্রতিটি পরতে ছিল কোরআনের প্রভাব। তার চিন্তা, দর্শন ও কবিতা কোরআনের আলোয় আলোকিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, কোরআনই মানবতার মুক্তির একমাত্র পথ এবং মুসলমানদের আত্মজাগরণের মূল উৎস। তাই তার কাব্য শুধু সাহিত্য নয়, বরং এক ধরনের দাওয়াত, যেখানে তিনি মুসলিম উম্মাহকে আহ্বান জানিয়েছেন কোরআনের দিকে ফিরে যেতে। কর্ডোবা মসজিদে তার আজান ও নামাজ ছিল সেই আহ্বানের উজ্জ্বল প্রকাশ। কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়া এক বন্ধ মসজিদে তার কণ্ঠে আজানের ধ্বনি যেন মুসলিম ইতিহাসের ঘুমন্ত চেতনাকে জাগিয়ে দিয়েছিল। কোরআনের প্রেমে, ইসলামের মহিমায় ও মুসলিম সভ্যতার পুনর্জাগরণের আকাক্সক্ষায় ইকবালের জীবন ছিল এক অবিনাশী আলোকস্তম্ভ, যা আজও বিশ্ব মুসলিমের অন্তরে প্রেরণা জাগায়।
লেখক : শিক্ষক ও প্রবন্ধকার
ভয়েস/আআ