শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১১ অপরাহ্ন
মোস্তফা কামাল:
ধর্মীয় ‘সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু’ রেখা টানার খেলাটা এবার একটু বেশি আগে শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচনে বা সময়ে-অসময়ে রাজনীতির এ অপখেলা বিভিন্ন সময়ে দেশে নানা সর্বনাশ ডেকে আনলেও তা বন্ধের উদ্যোগের কোনো নমুনা নেই। মাঝেমধ্যে স্থগিত রাখা হয় মাত্র। আবার সময় মতো এ তাস ফেলা হয় শুধুই নিজস্ব লাভ নিশ্চিতের মতলবে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ থেকে এবার বার্তা এসেছে কড়া ভাষায়। সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে কী দেবেন, কী নেবেন তা ভোটের আগেই পরিষ্কার করতে। ‘১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তবু দেশ কেন সাম্প্রদায়িক’ এ প্রশ্নও ছোড়া হয়েছে।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সংখ্যালঘুদের এ ধরনের প্রশ্নের তীর ছোড়া আচানক বা আজগুবি নয়। একদম আকস্মিকও নয়। এর নেপথ্যে লুকানো রয়েছে নানা ঘটনা। রাজনীতি বা ভোটের অঙ্ক মেলাতে চিকন বুদ্ধিতে সংখ্যালঘুদের ব্যবহারের কাজে আওয়ামী লীগ বরাবরই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। একতরফা বেনিফিশিয়ারিও। বছর কয়েক ধরে হেফাজতসহ দক্ষিণপন্থি বা ইসলামি নামধারী সংগঠনগুলোর বেশিরভাগও তাদের কব্জায়। সপ্তাহখানেক আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মারাত্মক মন্তব্য করেছেন। যার মধ্যে গুরুতর তথ্যের খোঁজ পেয়েছেন রাজনীতি সচেতনরা। অ্যাডভোকেট রানাদাশ গুপ্ত ও ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যরাও বেশি সময় না নিয়ে মুখ খুলে বসেছেন।
‘সময়টা খারাপ। এবার আমি ভয় পাচ্ছি যে অশুভ শক্তি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এমন কোনো ঘটনা যদি ঘটায়, যেটা হিন্দুদের সঙ্গে এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ফাটল ধরাতে পারে। রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী, দুর্বৃত্তরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। কাজেই এবার বেশি করে সতর্ক থাকতে হবে।’ এই ছিল ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য। এমন মন্তব্যে তিনি কাকে কী বার্তা দিলেন? না-কি প্রশ্ন আউটের মতো সামনে বাংলাদেশ-ভারত দুদেশের নির্বাচন, ধর্ম নিয়ে গরম রাজনীতির মৌসুম আসছে সেই সতর্কতা দিলেন? ঠাকুর ঘরে কে, আমি কলা খাই না প্রবাদও আলোচিত ভেতরে-ভেতরে।
এই চাপা আলোচনা ও কতক গুঞ্জনের মধ্যেই নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা ১০০ আসনের ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে বলে এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে সরকারকে জানালেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। সেইসঙ্গে সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তত বাড়ছে বলেও জানান তিনি। ক্ষমতাসীনদের প্রতি অভিযোগের আঙুল তুলে বলেন ‘নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়মে পরিণত হয়েছে। অথচ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় সংখ্যালঘু সুরক্ষা বিশেষ আইন প্রণয়নে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারটিই এখনো পূরণ করা হলো না’। গত বেশ ক’বছর ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর বিবিধ অত্যাচার, হয়রানি, নির্যাতন, একটিরও বিচার হয়নি বলে ক্ষোভ জানিয়ে আল্টিমেটামের মতো তিনি বলেন, ‘তাই কী দেবেন আর কী নেবেন, তার হিসাব-নিকাশ নির্বাচনের আগেই পরিষ্কার করতে হবে। নইলে নির্বাচনের মাঠে নামা আমাদের দ্বারা সম্ভব হবে না।’ একই দিনে আরেক অনুষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল এবং সহযোগী বামপন্থিরা একসঙ্গে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও দেশ কেন এত সাম্প্রদায়িক? পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের আর রাজনীতির দাবার গুটি না বানানোর আহ্বানও জানানো হয়।
বলার অপেক্ষা রাখছে না, দেশে সাম্প্রদায়িক বা সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি একটা ভিন্ন আবহের দিকে যাচ্ছে। এরপরও এখন পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশের চেয়ে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত ভালো পর্যায়ে। সেখানকার ক্ষমতাসীন দলের কিছু এজেন্ডার জেরে মণিপুর-আসামসহ বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সহিংসতা চলমান। এ নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে চলছে বিজেপি-কংগ্রেস পাল্টাপাল্টি দোষারোপ ও নানা তিক্ত কথা। এর গোটা রসদই লুকানো ক্ষমতার রাজনীতির পেটে। এ নিয়ে সাতচল্লিশে দেশভাগের মর্মন্তুদ বেদনা নিয়ে লেখা উর্দুভাষী ঔপন্যাসিক কৃষণ চন্দরের দাঙ্গার গল্প ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’র ভূমিকায় উর্দু কবি আলি সরদার জাফরির লেখা বড় প্রাসঙ্গিক। ঐতিহাসিকও। জাফরির লেখার কয়েকটি লাইন এমন ‘ভারত ও পাকিস্তানে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই আগুনের লেলিহান শিখায় মানুষ, ঘরবাড়ি আর পাঠাগারের পাশাপাশি আমাদের জীবন, স্বাধীনতা, সভ্যতা এবং কৃষ্টি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কয়েক মাসের ব্যবধানে এর তীব্রতা কিছুটা কমলেও এখনো সম্পূর্ণ কমেনি। ছাইয়ের নিচে আগুন এখনো চাপা পড়ে আছে, যা একটু ফুঁ দিলেই আবার জ্বলে উঠতে পারে। এই ছাইয়ে বাতাস দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই।’
‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’-এ ভারত-পাকিস্তানের কথা এসেছে। তখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। আজকের প্রেক্ষাপটে যা ভারত-বাংলাদেশ। দেশ দুটিতে ধর্মীয় রাজনীতির রূপ-বৈশিষ্ট্য প্রায় কাছাকাছি। যার যার সুবিধা মতো সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু দলকে কাজে লাগানোর নোংরামি সাতচল্লিশের চেয়ে এখন বরং আরও বেশি। কেবল ধরন পাল্টেছে মাত্র। কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, সুনামগঞ্জের শাল্লা বা রংপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের নানান জায়গায় কোরআন পোড়ানো, মন্দিরে হামলা ইত্যাদি ঘটনা রাজনীতির ফায়দা উসুলের একেকটি কদাকার উদাহরণ। ঘটনা প্যাঁচ খেয়ে গেলে কয়েকদিন হম্বিতম্বি, এরপর সব স্বাভাবিক। হোতাদের কিছু হয় না। সাধারণ মানুষ ভুলেও যায়। দগদগে ঘায়ের মতো ভোগে শুধু আক্রান্তরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের আক্রান্তরা চেয়ে চেয়ে দেখে তাদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর মামলার চার্জশিটভুক্ত ৩ আসামি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পায়। শাল্লার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিবাদকারী যুবক ঝুমন দাসের পরিণতিও তারা দেখেছে। বিষয়গুলো মোটেই সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুর চোখ দিয়ে দেখার বিষয় নয়।
ভারত উপমহাদেশে ধর্মের বিভাজনের জন্য প্রধানত ব্রিটিশ সরকারকে দায়ী করা হলেও এর প্রধান দায় রাজনৈতিক দলগুলোর। আরএসএস, আজকের বিজেপি, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ কে কম করেছে? আর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কে পিছিয়ে এ কাজে? ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট উসকে দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার ঘটনা তো রয়েছেই। পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে ধর্মীয় সুবিধা নিতে কে বেশি ইবাদতি, কে বেশি নামাজি, কে বেশি তসবিহ জপেন এসব পাল্টাপাল্টি দাবির মধ্যে সাম্প্রদায়িক ইন্ধন সবাই জুগিয়েছেন। আবার নিজেদের অসাম্প্রদায়িক-আধুনিক প্রমাণ দিতে গিয়ে মঠ-মন্দিরে গিয়ে নাটকীয়তাই দেখে আসছি। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মের এই কৃত্রিম ব্যবহারে রাজনীতিবিদদের ভেল্কি কেবলই ধাবমান। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের ঐক্য পরিষদ সেখানে ঝাঁকুনি দিয়েছে? নাকি তারা ভিন্ন কিছুর হিসাব মেলাচ্ছে এ প্রশ্নও আছে। রাজনীতির ময়দানে বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে একদিকে সংখ্যালঘু প্রীতি, আরেকদিকে ইসলমপন্থি নানা দলকে বাগে আনার চেষ্টা একদম স্পষ্ট। একে যোগ্যতা-দক্ষতা, রাজনৈতিক ক্যারিশমা বা হেডমের বাহাদুরি হিসেবে দেখানোরও প্রয়াশ দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ দক্ষ হাতে ডান-বাম একাকার করার একটি রেকর্ড গড়তে পেরেছে। সংখ্যালঘুদের আয়ত্তে রাখার দৃষ্টান্ত রেখে চলছে। আবার হাতের মুঠোয় নিয়েছে সংখ্যাগুরুদের শিরোমণি হেফাজতকে। জামায়াতও অনেকটা তাদের কব্জায়। একই পথে বাদবাকি ইসলামি দলগুলোও।
এক দশকের ব্যবধানে হেফাজতের সেই দাপট ও সাংগঠনিক অবস্থান নেই। যতটুকু টিকে আছে সরকারের আশকারা-মস্করায়। হেফাজত গুরুত্ব ও প্রভাব হারানোর প্রভাব পড়েছে হেফাজত-সংশ্লিষ্ট কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপরও। তাদের দিন কাটছে বড় ‘ছিদ্দতে’। কারও কারও না খেয়ে মরার অবস্থা। সরকার পরিমাণ মতো কিছু দিলে পেটে পড়ে। হেফাজতের নেতৃত্বের সিংহভাগই কোনো না কোনো ইসলামি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন বা ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে হেফাজতের মামলায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতারা আসামি। ম্যাজিকের মতো অ্যাকশন। মামলা-গ্রেপ্তারসহ নানামুখী চাপে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল দুর্বল হতে হতে এখন টিকে আছে সরকারের দান-দক্ষিণা-হাদিয়ায়।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামি দল ১০টি। এর মধ্যে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দল আছে ৬টি। সেগুলো হলো ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস। চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন ছাড়া বাকি পাঁচটি দলই হেফাজতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। হেফাজতের পাশাপাশি এসব দলও মামলা, গ্রেপ্তারসহ নানামুখী চাপে আছে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির সভা-সমাবেশ ও ধর্মীয় মাহফিল করার ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়তে হয়নি। হেফাজতে থাকা ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস এই পাঁচ দল একসময় বিএনপির সঙ্গে জোটে ছিল। এখন যেদিন যেদিকে পারে ছোটে। কাউকে ‘না’ করে না। রহস্যজনকভাবে বিএনপির মধ্যে গত মাস কয়েক ধরে দক্ষিণ নিয়ে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এ রহস্যের বিপরীতে তাদের নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে ব্যাপক মনোনিবেশ। খুচরা-আতিপাতি ধরনের ‘ইসলাম’ নামযুক্ত দলকে দিয়ে সরকার এরইমধ্যে কয়েকটি জোটও করে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ডানা না কেটে আরও গজাতে দিয়ে সরকারি মহল কোন সাফল্যের দিকে ছুটছে, তা বুঝতে বেশি সময় নাও লাগতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট
mostofa71@gmail.com