মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৭:০৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ঘুমন্ত বিবেক ডুবন্ত মানবতা

রায়হান আহমেদ তপাদার:
মানবিক মূল্যবোধ কি দিন দিন কমে যাচ্ছে? এ প্রশ্ন চলমান সমাজে ব্যাপকভাবে উত্থাপিত হচ্ছে। এর প্রধান কারণ ইদানীং ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা। মৃত্যু, অপমৃত্যু ও দুর্ঘটনা বিশ্বে এখন ডাল-ভাতের মতো। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হওয়ার আগেই বিশ্বের শতকোটি মানুষ রাজনৈতিক, মানবিক ও অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের শিকার হয়েছে। তবে সামাজিক জীবনযাপনের তাগিদে বা নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সে বিপরীতমুখী আচরণও করে। নিজেকে ক্ষমতাবান হিসেবে প্রকাশ করার লিপ্সায় মত্ত হয়। তখন উপকারের রূপ বদলে গিয়ে তা স্বার্থসিদ্ধির পন্থায় পরিণত হয়ে যায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও প্রতিযোগিতার যুগে মানুষ ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও সহিংসতা, রক্তপাত, হানাহানি, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা আর উন্মাদনার যে চিত্র প্রায় নিত্য ফুটে উঠছে এতে মানবতা আজ বিপন্ন। পৃথিবীতে মানুষের যা কিছু উদ্যোগ ও উদ্যম সবকিছুই শান্তিতে বেঁচে থাকার লক্ষ্য ঘিরে আবর্তিত হয়। পৃথিবী সুখময়, না দুঃখময় এ নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, বিশ্বে নিরাপদে বেঁচে থাকার সাধনাতেই মানুষ নিজেকে ব্যস্ত রাখে। এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, জো বাইডেনের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব অন্ধের মতো ইসরায়েলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে ইসরায়েল পরিষ্কার বার্তা পেয়ে গেছে যে, গণহত্যার জন্য তারা লাইসেন্স পেয়ে গেছে! এখন যা খুশি তা-ই করতে পারে। তারা হাসপাতালে, উপাসনালয়ে, শরণার্থী শিবিরে সব জায়গায় বোমা ফেলছে। এমন জায়গা তারা নিশানা করছে, যে জায়গাগুলোয় দিশেহারা ফিলিস্তিনিরা আশ্রয় নিয়েছেন। তারা খাবার, পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি সব বন্ধ করে দিয়েছে।

এমন ঘটনা বিশ্বের কোথাও কখনো ঘটেনি। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও নয়। গাজার বাসিন্দারা হলোকস্টের চেয়েও বড় হলোকস্টের মধ্যে আছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে বিশ্ববাসীর জিজ্ঞাসা, তার কেমন লাগছে এসব দেখে? ঋষি সুনাক, মাখোঁ, জার্মান চ্যান্সেলর তাদের প্রতিক্রিয়া কী? এ পর্যন্ত চার হাজারের বেশি শিশু খুন হয়েছে। তারপরও তারা ঘুমান কী করে? ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। যখন এসব নেতা-নেত্রীর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি ইতিহাসে পড়বে যে, তাদের পূর্বপুরুষ এসব করেছেন, তখন তারা কী জবাব দেবেন? যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স এই হত্যাকাণ্ডের সহযোগী, তাতে সন্দেহ নেই। যে বোমা গাজায় ফেলা হচ্ছে, সেই বোমা আমেরিকায় তৈরি, যে জাহাজ তারা ব্যবহার করছে, সেটাও আমেরিকার। ইসরায়েলের কাছে যত অস্ত্রশস্ত্র আছে, সবই আমেরিকা ও পশ্চিমাদের তৈরি। এই গণহত্যার জন্য তারাই দায়ী। এবার রোগ নির্মূল করতে চায় ফিলিস্তিন। যদি রোগ নির্মূল না হয়, তাহলে তারা সহিংসতার বৃত্তে ফিরে যাবে। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা যে কষ্ট ভোগ করছেন, পরবর্তী ৭৫ বছরেও সেই কষ্টের শেষ হবে না। ইসরায়েল যদি মনে করে, তারা সব ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করে পুরো দেশ নিয়ে থাকবে, তা-ও তারা শান্তিতে থাকতে পারবে না।

ফিলিস্তিন দখলদারের খপ্পরে পড়া একটা দেশ। গাজা ফিলিস্তিনের দক্ষিণ দিককার প্রদেশ। পশ্চিম তীর দখলদারদের কর্র্তৃত্বে চলে গেছে। পশ্চিম তীরে যেতে হলে ইসরায়েলের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এটা একটা ছোট্ট এলাকা। এর আয়তন ৩৬৩ বর্গকিলোমিটার। দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৫-১৭ কিলোমিটার। মিসরের রাফার সঙ্গে একটি সীমান্ত আছে। একদিকে ভূমধ্যসাগর। পূর্ব ও উত্তর দিকে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনকে এক রকম ঘিরেই রেখেছে ইসরায়েল। অনেকে গাজাকে উন্মুক্ত জেলখানা বলে। বিশ্লেষকদের মতে, এটা একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছাড়া কিছুই নয়। নাৎসিরা যেমন করেছিল, এটাও তেমন। ইসরায়েল বলতে চাইছে, গাজার ভেতর থেকে তারা সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে সরে তারা কোথায় গেছে? তারা গাজার চারপাশ সৈন্য দিয়ে ঘিরে রেখেছে। এভাবে গাজার দম বন্ধ করে ছাড়ছে। গাজাবাসী গাজা থেকে বের হতে পারেন না, ঢুকতেও পারেন না। যদি এক হাজার মানুষ গাজা থেকে অন্যত্র যেতে চান, ইসরায়েল চার-পাঁচজনকে অনুমতি দেয়। খাবার, ওষুধবাহী গাড়ি হলেও ইসরায়েলিদের অনুমতি নিতে হয়। গাজায় ২০০৮, ২০১২, ২০১৪, ২০২১, ২০২২ সালেও হামলা হয়েছে। গাজার ৬০ ভাগ বিধ্বস্ত। তাদের বাড়িঘর নেই। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁবুতে বাস করেন। এই অঞ্চলের ৭৫ ভাগ মানুষের কাজ নেই। বেকার এই মানুষগুলো বাকি ২৫ ভাগের ওপর নির্ভর করে। গাজার মানুষ রামাল্লার ওপর নির্ভরশীল। ইসরায়েল পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। এর বিল দেয় রামাল্লা। গাজায় ৩৫টি হাসপাতাল আছে। বন্ধুরাষ্ট্রগুলো এখানকার মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল করে দিয়েছে। জাতিসংঘের স্কুলে বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে। তারা শিক্ষাকে সবচেয়ে মূল্যবান মনে করে। এই মুহূর্তে গাজার হাসপাতালগুলোয় বাংলাদেশ থেকে পাস করা ৩০ জন ডাক্তার কাজ করছেন। ফিলিস্তিনি কর্র্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। ইসরায়েলিরা যা করেছে তা হলো তারা হাসপাতালগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কারণ, এখানে এসে মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক হাসপাতাল জ্বালানির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ না থাকলে ইনকিউবেটরে থাকা বাচ্চারা কীভাবে বাঁচে? অস্ত্রোপচার কীভাবে চলছে! নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র প্রায় বন্ধ। আলো ছাড়া তো অস্ত্রোপচার হয় না। হাসপাতালগুলো ধসে পড়েছে। শোনা যাচ্ছে, জো বাইডেন যুদ্ধে বিরতি চান। তারা কখনো গাজায় এসে দেখেননি, এখানে কী অবস্থা? তারা এখনো ইসরায়েলের পেছনে দাঁড়াতে চান। কিন্তু তাদের জনগণই বিরোধিতা করছেন। তারাও বলছেন, যথেষ্ট হয়েছে। এখন তাদেরও মূল্য চুকাতে হবে। ফিলিস্তিনিরা সর্বস্ব দিয়ে দিয়েছে। মানুষের তো বিবেক-বুদ্ধি আছে। তারা জানে বর্বরতা দেখেও চুপ করে থাকার অর্থ বর্বরতাকে সমর্থন দেওয়া। মানুষ সেটা করতে পারে না। কিন্তু এ কথা সুনিশ্চিত, বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই তাদের নেতাদের জবাবদিহি করবে।

বিশ^জুড়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছে ফিলিস্তিন। তারা রক্ত দিচ্ছে, তাদের শিশুসন্তানরা জীবন দিচ্ছে, তাদের নারীরা মরছেন, এমনকি তাদের ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু এসব কিছুর বিনিময়ে তারা মানুষের হৃদয়টা পেয়েছে। মানুষের সমর্থনই এখন তাদের ভরসা। গাজার মানুষের খাবার, পানি, ওষুধ, জ্বালানি দরকার। তাদের কাগজে কী লেখা আছে, তা এখন জানার দরকার নেই। ২২টি আরব দেশ ট্রাকে পতাকা তুলে গাজা সীমান্তে গিয়ে দাঁড়াক। জোর করে ঢুকে পড়ুক। ইসরায়েল কী করবে? তারা সেটা কেন করছে না? জর্দান ইসরায়েলি কূটনীতিবিদকে বের করে দিয়েছে। আরও চারটি দেশ আছে, যাদের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক আছে। তারাও নিজেদের কূটনীতিক প্রত্যাহার করে ইসরায়েলি কূটনীতিককে বের করে দিতে পারে। অন্তত এটা তো তারা করতে পারে। তারা জোর গলায় বলতে পারে, যথেষ্ট হয়েছে। তোমাকে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে।

ফিলিস্তিনের ৭০ ভাগ মানুষ কোনো দলকেই সে অর্থে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেন না। তবে এক জায়গায় সবাই এক। সবাই স্বাধীনতা চায়। শান্তি চায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি দেখি, তাহলে দেখতে পাই জাতিগত সংঘাত। এক ধর্ম অন্য ধর্মের বিকাশকে কীভাবে ব্যাহত করবে, সেই পরিকল্পনায় ব্যস্ত। যত আধুনিক আমরা হচ্ছি, ততই সংঘাত বাড়ছে, মানুষ মারার নতুন নতুন যন্ত্রকৌশল তৈরি হচ্ছে, এতে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো বাহবাও পাচ্ছে! একেক শক্তির প্রভাবে একেকজন দমিত হচ্ছেন, এর রেশ ধরে অন্য কোনো জায়গায় আরও নতুন ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতাবাদ আধুনিক পৃথিবীর কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না। এমতাবস্থায় প্রশ্ন জাগতেই পারে, আগামী দিনের পৃথিবী কোন দিকে যাচ্ছে। আসলেই আমাদের ভাবিয়ে তুলে আগামীর পৃথিবী কি শুধু শক্তিমত্তার জয়গানে ভরে উঠবে, নাকি সব মানুষ সমান সুযোগে বাঁচবে?

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

raihan567@yahoo.com

ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশ রূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION