মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১৮ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

কয়েকশ বছরের ঈদ উৎসব

ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
মুঘল সাম্রাজ্যের হাত ধরে যে রেওয়াজ চালু হয় তার মূল ধারণায় ঈদ আজও পালিত হচ্ছে বাংলায়। বিভিন্ন সূত্র অবলম্বনে লিখেছেন সালাহ উদ্দিন শুভ্র

‘ঈদের দিনে কী খাব, কোরমা-পোলাও-ঘি খাব’, ঈদ আসলে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কচি-কচি কণ্ঠে আগে এসব উৎসবধ্বনি শোনা যেত। ঈদ সবার মনে খুশির সংবাদ নিয়ে আসত। ধনী-গরিব নির্বিশেষে চাঁদ দেখতে যাওয়া, ক্ষীণ-বাঁকা চাঁদ দেখতে পেলে হর্ষধ্বনি করা, ঈদের দিন একসঙ্গে নামাজ-কোলাকুলি আর খাওয়া-দাওয়ার রীতিগুলো পুরনো। ইতিহাসের বিভিন্ন দলিল বলছে এগুলো কয়েকশ বছরের পুরনো।

তবে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাঙালি মুসলমানরা তাদের ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি। মুঘলদের পর ব্রিটিশ শাসনের আমলে এ অঞ্চলে ঈদ উদযাপন অনেকটা খেই হারিয়ে ফেলে। এরপর পাকিস্তানি শাসন বাঙালি মুসলমানদের ওপর চেপে বসে। নতুন ভূখণ্ডে ঈদ আরও আনন্দ নিয়ে হাজির হওয়ার কথা থাকলেও, ঘটে উল্টো। তবে পাকিস্তানি শাসকদের নৃশংসতাকেও পরাজিত করে এ ভূমির মানুষরা। যুদ্ধে পাকিস্তান পরাস্ত হলে নতুন বাংলাদেশে ঈদ আবার উৎসবের প্রধান উপলক্ষ হয়ে ওঠে। যা দিনে দিনে নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত করেছে।

শুরু

মুঘল আমলে রমজান এবং তারপর ঈদ উদযাপনের বিভিন্ন লিখিত সূত্র পাওয়া যায় দিল্লিসহ ভারতের কিছু অংশে। বাংলা অঞ্চলে ঈদ উদযাপন শুরু হয় তারও পরে। তবে অনুষ্ঠান আয়োজনের অনেক মিল পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, খ্রিস্টীয় ১৬২৮ আগ্রার সিংহাসনে বসেন পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহাবুদ্দিন মুহম্মদ শাহজাহান। তার আমলে রমজানের প্রতিদিন বিকেলে সম্রাটের পক্ষ থেকে দরিদ্র মানুষদের মধ্যে অর্থ বিতরণ করা হতো। যেদিন সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ দেখা যেত, সেদিন সম্রাটের পক্ষ থেকে বাদ্য বাজিয়ে ঈদের আগমন ঘোষণা করত। আর ঈদের সকালে যুবরাজ, অভিজাত ব্যক্তি ও রাজকর্মচারীরা সম্রাটকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাত। এরপর সবাইকে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তেন সম্রাট। ঈদগাহ যাওয়া-আসার পথে স্বর্ণমুদ্রা বিলাতেন। রাজপ্রাসাদ থেকে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে সম্রাটের এ যাত্রা ছিল জাঁকজমকে পরিপূর্ণ। গোটা শহর এ উদ্দেশ্যে নতুন সাজে সেজে উঠত। ঘরবাড়ি, হাটবাজার সবকিছু কারুকাজ করা নানা কাপড়ে সাজানো হতো। আশপাশের শহর ও গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক আগ্রায় জড়ো হতো সম্রাটকে এক নজর দেখতে।

মুঘলরা আসার আগে বাংলায় রোজা বা ঈদ উদযাপন বিষয়ে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। কারণ মুসলমানরা তখন ক্ষমতাসীন বা সংগঠিত ছিল না। এ ছাড়া তখন তারা ছিল গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক। বাংলায় প্রথম মুঘল সুবাহ আসে (রাজ্য) ১৬১০ সালে। এ সময় সুবেদার (প্রাদেশিক গভর্নর) ইসলাম খানকে ঢাকায় পাঠানো হয়। বাংলার সংস্কৃতিতে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তবে ঢাকায় ঈদ উদযাপনের প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় আজাদ হোসেন বিলগ্রামী রচিত ‘নওবাহার ই মুর্শিদকুলি খান’ বইয়ে। মুর্শিদকুলি খান ১৭০০ থেকে ১৭০২ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন। তার জামাতা সুজা-উদ-দীন মুহম্মদ খান পরে সিংহাসনে বসেন। জানা যায়, তার সময়ে পুরাতন দুর্গ থেকে ঈদগাহ পর্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ মিছিল হতো। বর্তমান সাতমসজিদ রোডে অবস্থিত ছিল ওই ঈদগাহ। মিছিল থেকে গরিবদের প্রচুর টাকা বিলানো হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগেও এটি ঈদগাহ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত। তখন স্থানীয়দের দ্বারা মেলারও আয়োজন হতো বলে জানা যায়। মেলাকে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বলে মনে করা হতো তখনো। নাথান তার বাহারিস্তান-ই-গায়বিতে উল্লেখ করেন, ঢাকায় কামান ও বন্দুক দিয়ে রমজান শুরুর ঘোষণা দেওয়া হতো।

জানা যায়, ইফতার আয়োজনেও মুঘল সেনারা একসঙ্গে হতেন। আবার মুঘলরা ইতিহাসে আলোচিত তাদের রান্নাঘরের জন্য। শুধু বিরিয়ানি, কিমা, পোলাও, বাকরখানি নয় বাদাম বা সুজি দিয়ে তৈরি রুটি এবং কাবাব তৈরিতে তাদের পাচকরা ছিলেন অতুলনীয়। এ ছাড়া শিক, সুতলি, শামি, হান্ডি, মোসাল্লাম বিভিন্ন কাবাব তৈরিতে তারা ছিল সিদ্ধহস্ত। মাছের কাবাবেরও জুড়ি মেলা ভার। খোরাসানি পোলাও বা জিলাপি তৈরির কথাও বাদ দেওয়া যায় না। ইফতার বা ঈদের আয়োজনে এসব ছিল সাধারণ।

ঢাকার ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ ছিল ঈদের দিনের শোভাযাত্রা। জাঁকালো মিছিলটি আয়োজন করতেন মুঘল আমলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদের ‘নায়েব নাজিম’রা। ধারণা করা হয় ১৭৬৬ সালের দিকে এ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি ঢাকার নিমতলীতে অবস্থিত তাদের প্রাসাদ থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে আবার একই জায়গায় শেষ হতো। শোভাযাত্রায় থাকত বড় হাতি, বাহারি সজ্জিত উট, ঘোড়া ও পালকি। নায়েব নাজিমরা হাতির পিঠে বসে থাকতেন। এ ছাড়া থাকত উজ্জ্বল রঙের পতাকা, ড্রাম এবং বিউগল।

বাঁক বদল

ঈদুল ফিতরের আয়োজন ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই উৎসাহ-উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে। বন্ধ হয়ে যায় ঈদের দিনের শোভাযাত্রা। তবে ঢাকার নবাবদের অনেক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবার মুঘল যুগের ঐতিহ্য বজায় রাখে। এর মধ্যে নাম করা যায় খাজা বা নবাব পরিবারের। আগে যেমন ধানম-িকে কেন্দ্র করে ঈদের নামাজ পড়া হতো, অথবা নিমতলী থেকে শুরু হতো শোভাযাত্রা; ব্রিটিশ আমলে সেটি পাল্টে যায়। লালবাগ শাহী জামে মসজিদ ও নবাববাড়ি মসজিদ হয়ে ওঠে ঈদের প্রধান জামাতের স্থান। এর কারণ ব্রিটিশরা নায়েব নাজিমের পদটি উচ্ছেদ করে। তাদের শাসনব্যবস্থায় মুঘলদের সমস্ত ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়। ঢাকা গুরুত্ব হারাতে থাকে। এ সময়ে নবাববাড়ি বা বিখ্যাত আহসান মঞ্জিল ছিল ‘চান রাতে’ নতুন চাঁদ দেখার সেরা স্থান। চাঁদ দেখা না গেলে নবাববাড়ি থেকে ফাঁকা গোলা ছুড়ে জানান দেওয়া হতো। ঈদের দিন নগরীর বিভিন্ন স্থানে যেমন চক, আরমানিটোলা, রমনা সবুজ প্রভৃতি যেখানে খোলা জায়গা ছিল সেখানে মেলার আয়োজন করা হয়। শুধু সর্বস্তরের মানুষই জড়ো হতেন না, নবাব পরিবারের সদস্যরাও তাদের দেখতে যেতেন। আবার আহসান মঞ্জিলের ভেতর নাচ-গান সহযোগে ভোজের আয়োজন ছিল। যদিও সেখানে শুধু নিমন্ত্রিতরা যেতে পারতেন। আরও জানা যায়, ঈদ উদযাপনের অংশ হিসেবে নবাববাড়িতে নাটক, থিয়েটার মঞ্চস্থ হতো এবং শেষে বায়োস্কোপ দেখানোর আয়োজনও ছিল। আরও দাবি করা হয়, সাহরির সময় কাসিদা শুরু করে নবাববাড়ি।

পাকিস্তান শাসনামলে কিছু কিছু ঐতিহ্য আবার ফিরে এলেও, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল মুসলমানরা সেই জাঁকালো ঈদ ফিরিয়ে আনতে পারেনি। অচিরেই পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালি ও অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন শুরু করে। এমনিতে শিল্প-কারখানা-চাকরিতে পিছিয়ে থাকা পূর্ববাংলার মুসলমানরা এমন অত্যাচারে আরও অসহায় হয়ে পড়ে। তবে তারপরও মুসলমানদের নিজস্ব পরিচয়-ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রয়োজনে ঈদ উদযাপনে বিপুল মানুষের উপস্থিতি ছিল তখন। মূলত পুরান ঢাকাকে কেন্দ্র করেই এ সময়ে ঈদের আয়োজনগুলো হতো। যার ভেতর মুঘল আমলের চিহ্নগুলোও থেকে যায়। তবে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়নের মুখে ঈদ উদযাপন হারিয়ে ফেলে সব খুশি।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঈদের দিনের বিবরণ দিতে গিয়ে শহীদ রুমির মা জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘আজ ঈদ। ঈদের কোনো আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারও জামাকাপড় কেনা হয়নি। দরজা-জানালার পর্দা কাচা হয়নি। ঘরের ঝুল ঝাড়া হয়নি। বাসায় ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদানি। শরীফ, জামী ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি। কিন্তু, আমি ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়িতে? তাদের খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও-কোর্মা, কোপ্তা-কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপিচুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াব। তাদের জামায় লাগিয়ে দেওয়ার জন্য এক শিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।’

নতুন আয়োজনে

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আমলে অবশ্য বাঙালি মুসলমানরা তাদের ঈদ উদযাপনের খোরাকি পেয়ে যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের দৌলতে। শিক্ষা, শাসনব্যবস্থা থেকে বাঙালি মুসলমানের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার এ সময়ে আব্বাসউদ্দীন তাদের উপহার দিতে চেয়েছিলেন একটি গান। সাধারণ মানুষের জন্য একটি ‘কাওয়ালি’ রচনার ধারণা দেন। যে ধারণা অনুসরণ করে নজরুল ইসলাম ঈদুল ফিতরের জন্য একটি গান লেখার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এমন একটি গানের কথা ভাবেন যা ধনী-দরিদ্র, শহর ও গ্রামীণ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আবার ফিরিয়ে আনবে। গ্রামোফোন কোম্পানির মালিক ভগবতী বাবুর সঙ্গে আব্বাসউদ্দীনের অনুরোধের পরই নজরুল গানটির কথা নিয়ে আসেন। মাত্র ৩০ মিনিট সময় নিয়ে নজরুল ইসলাম লিখে ফেলেন ‘ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে…’। মাত্র আধাঘণ্টায় লেখা হয়ে যায় অমর গান।

স্বাধীন বাংলাদেশে এ গানই ঈদুল ফিতর উদযাপনকে পুনরুজ্জীবন দেয়। রমজানের শেষে আকাশে ঈদের চাঁদ দেখা গেলে এখনো বেজে ওঠে সেই গান। এরসঙ্গে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ঈদ উৎসব পালনেও যোগ হয় নতুন নতুন প্রপঞ্চ। যেমন ঈদ উপলক্ষে টেলিভিশনগুলো এখন কয়েক দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দৈনিক পত্রিকাগুলোরও ঈদসংখ্যাসহ বিভিন্ন আয়োজন থাকে। দেশজুড়ে রয়েছে বর্ণিল সব শপিংমল। কেনাকাটার আনন্দ আরও বেড়ে যায় এ সবের ফলে। ঈদ এখন অনেক বড় এক অর্থনৈতিক যজ্ঞেরও উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। রমজান মাসজুড়ে ইফতার আয়োজন থেকে শুরু করে ঈদের দিনের আপ্যায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিপুল অর্থনৈতিক লেনদেন হয়।

ভয়েস/আআ/সংগৃহিত

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION