বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ০১:৩৩ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

‘স্বাধীনতা সূচকে নিম্নগামী’ আসল সমস্যা কী?

তাপস রায়হান:
সমৃদ্ধিতে আমাদের দেশ এগিয়েছে। এটা বর্তমান সরকারের দলীয় রাজনৈতিক মতাদর্শে অবিশ্বাসী মানুষও স্বীকার করেন। কিন্তু তাদের স্বীকারোক্তিতে একটু গাঁইগুঁই থাকে। ভাবে কিংবা চাহনিতে বোঝা যায় এক ধরনের অসহায় ক্রোধ। সরকারের কোনো কাজে সামান্য অসংগতি বা ত্রুটি ধরা পড়লে, সেই ক্রোধান্বিত নিস্তেজ মানুষগুলো হইহই করে ওঠেন। শোনা যায়, গেল গেল রব। আর বিদেশি কোনো প্রতিবেদনে সরকারের সমালোচনা থাকলে তো কথাই নেই। তবে এর মানে এই নয় যে সব দায় বিরোধীদের কাঁধে চাপিয়ে সরকার আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলবে। কোনো কাজের যৌক্তিক সমালোচনা করার পাশাপাশি, দিকনির্দেশনা থাকলে সেই বিষয়ে বিতর্কের সুযোগ থাকে না। কিন্তু যে ‘স্বাধীনতা’কে কেন্দ্র করে বর্তমান সরকার আবর্তিত হচ্ছে, সেই সূচকে যখন অবনতি হয় তখন স্বাধীনতায় শ্রদ্ধাশীল মানুষের নীরব থাকা অন্যায়। যদিও বর্তমানে কোনটা ‘ন্যায়’ আর কোনটা ‘অন্যায়’ তার নতুন সংজ্ঞাও আমাদের অজানা।

কেন এবং কী কারণে, স্বাধীনতা সূচকের নিম্নগামিতা তা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, গ্লোবাল ফ্রিডম অ্যান্ড প্রসপারিটির রিপোর্ট। বৈশ্বিক স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি প্রতিবেদনে (গ্লোবাল ফ্রিডম অ্যান্ড প্রসপারিটি রিপোর্ট) বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৪ দেশের মধ্যে ১৪১তম। এর মধ্যে স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতাবঞ্চিত’ ক্যাটাগরিতে। তাহলে এই বঞ্চিত ক্যাটাগরিতে বাকি থাকল কয়টি দেশ? মঙ্গলবার ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) এবং দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘প্রসপারিটি অ্যান্ড গুড গভার্নেন্স’ (সমৃদ্ধি এবং সুশাসন) শীর্ষক সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। পরে সংক্ষেপিত আকারে দূতাবাসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সমৃদ্ধি সূচকের তালিকা করার জন্য স্বাস্থ্য, বৈষম্য, পরিবেশগত অবস্থা, সংখ্যালঘু অধিকার এবং শিক্ষাসহ মাথাপিছু জিডিপির মতো বিভিন্ন কারণ বিবেচনা করা হয়েছে। অন্যদিকে স্বাধীনতা সূচকের তালিকা করার জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আইনি অবস্থার পরিমাপ করা হয়েছে। এর আলোকে গবেষণায় দেখা গেছে, মৌলিক স্বাধীনতা জোরদার করলে সেটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে গতিশীল করে। প্রশ্ন হচ্ছে, মৌলিক স্বাধীনতা আসলে কী বিষয় তা আমাদের দেশের কত শতাংশ মানুষ জানেন! নাকি তারা ঠিকই জানেন, সমাধানের ক্ষমতা রাখেন না যে কারণে স্বাধীনতা সূচকের অবনতি হচ্ছে? সম্মেলনের মূল বক্তা আটলান্টিক কাউন্সিলের স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি কেন্দ্রের পরিচালক জোসেফ লেমোইন প্রতিবেদনের মূল ফলাফলগুলো তুলে ধরেন। প্রতিবেদনে স্বাধীনতা সূচক এবং সমৃদ্ধি সূচকের ওপর ভিত্তি করে গণতান্ত্রিক এবং শাসন সূচক ব্যবহার করে একটি জাতির অর্থনৈতিক অবস্থানের মূল্যায়ন করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংকটির প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ সমৃদ্ধিতে ভারত-পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেলেও পিছিয়েছে স্বাধীনতার সূচকে। প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, যে সব দেশ শক্তিশালী আইনি ব্যবস্থাসহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা উৎসাহিত করে, তারা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি করে স্বাগত জানায়। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, প্রতিটি দেশ দুর্নীতির মতো বিষয়ে এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে লড়াই করছে। কিন্তু মূল বিষয় সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া নয়, সক্রিয়ভাবে স্বীকার এবং মোকাবিলা করা। তিনি আরও বলেন, আটলান্টিক কাউন্সিল যে ১৬৪ দেশকে তালিকাভুক্ত করেছে সেখানে (স্বাধীনতা সূচকে) ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরাধীন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত দেশগুলো ‘সমৃদ্ধিশালী’ দেশ হিসেবে (সমৃদ্ধি সূচকে) তালিকাভুক্ত হয়নি। এ থেকে বোঝা যায়, সমৃদ্ধিশালী হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনি স্বাধীনতা বৃদ্ধি করতে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে।

ন্যায়সংগত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং আয়ের বৈষম্য কমাতে আটলান্টিক কাউন্সিল প্রগতিশীল কর নীতিমালা বাস্তবায়ন, শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচিতে বিনিয়োগ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগের জন্য একটি সক্ষম পরিবেশ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছে। এসব সমস্যার কথা অনেকেই বিভিন্ন মিডিয়ায় বলেছেন। কিন্তু সরকার কোনো ‘গা’ করেনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মসংস্থানের কাঠামোগত সমস্যা সমাধান করা উচিত এবং একটি সর্বজনীন ও সমৃদ্ধিশালী অর্থনীতি তৈরি করতে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা উচিত। আটলান্টিক কাউন্সিল মনে করে, বাংলাদেশকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। শুধু সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি এবং শিক্ষার প্রসার বৃদ্ধিই নয়, শিক্ষার মান উন্নয়নের দিকেও লক্ষ রাখতে হবে এসব নিয়ে বিতর্কের তেমন সুযোগ নেই। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় ধারাবাহিক অগ্রগতি এবং কাঠামোগত প্রচেষ্টার অভাব খুঁজে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশকে এ সংকট সমাধানে আইনি কাঠামো এবং আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উন্নত করার দিকে মনোনিবেশ করতে বলা হয়েছে। এটা অনেকেই স্বীকার করবেন সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার জন্য সরকারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। বলা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা নারী সরকারপ্রধান হতে যাচ্ছেন। এটি স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিলেও কর্তৃত্ববাদী দলীয় ব্যবস্থাগুলো প্রায়ই বিভিন্ন ঝুঁকির মুখোমুখি হয়, যা সুশাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই ঝুঁকিগুলো কমানোর জন্য রাজনীতি, সরকারব্যবস্থা এবং অর্থনীতিতে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।

সবকিছুই ঠিক ছিল। কিন্তু একটা বিষয়ে খটকা লেগেছে। ‘কর্তৃত্ববাদী দলীয় ব্যবস্থা’ যদি প্রায়ই ঝুঁকির মুখোমুখি হয়, তাহলে বিশে^র বিভিন্ন দেশে যারা দীর্ঘসময় ক্ষমতায় ছিলেন তখনো কি তারা ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছিলেন? যদি হয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানেরও চেষ্টা করেছেন। ফিনল্যান্ডের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট ছিলেন তারিয়া হ্যালোনেন। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১২ বছর। যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচারও ১২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। যিনি পরিচিত ছিলেন ‘আয়রন লেডি’ হিসেবে। আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মেরি ম্যাকআলিস। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৪ বছর। তিনিও ছিলেন আয়ারল্যান্ডের নির্বাচিত প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। ডমিনিকার প্রধানমন্ত্রী ইয়েগনা চার্লস ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় ১৫ বছর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় ১৫ বছর। ভিগদিস ফিনবোয়াদিতর ছিলেন বিশে^র প্রথম আইসল্যান্ডের নির্বাচিত নারী প্রেসিডেন্ট। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৬ বছর। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলও ক্ষমতায় ছিলেন ১৬ বছর। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে ১৮ বছর সরকারপ্রধান ছিলেন। তখন কি এই ধরনের ‘কর্তৃত্ববাদী দলীয় ব্যবস্থা’র কথা বলা হয়েছিল? যদি বলা হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই সমস্যা সমাধানেরও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বিশ্বে দীর্ঘসময় রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ক্ষমতায় রয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারপ্রধান হিসেবে দুই দফায় চতুর্থবারের মতো ২০ বছর ক্ষমতায় রয়েছেন তিনি। এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। ফলে সমস্যাগুলো আরও ভালোভাবে চিহ্নিত করে সমাধানের পথে হাঁটাই উত্তম। কিন্তু এর বাইরেও যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে প্রশ্ন সেটা কি অভ্যন্তরীণ নাকি বৈশ্বিক!

লেখক : সাংবাদিক

tapas.raihan@gmail.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION