বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৯:০৩ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

পরিবেশদূষণ রোধে ইসলামের নির্দেশনা

মুফতি আতিকুর রহমান:
আল্লাহতায়ালা পৃথিবীকে করেছেন মানুষের আবাসস্থল। পৃথিবীর পরিবেশকে করেছেন মানুষের বাস উপযোগী। আর পরিবেশের প্রতিটি উপাদানকে করেছেন মানুষের জীবন ধারণের সহায়ক। যা বিভিন্নভাবে আমাদের জীবনে প্রাণশক্তি সঞ্চার করে। আমরা জানি পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ থেকে ওজোন স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিমণ্ডলে বিদ্যমান আলো, বাতাস, পানি, মাটি, বন, পাহাড়, নদী, সাগরসহ উদ্ভিদ ও জীবজগৎ সমন্বয়ে যা সৃষ্টি তাই পরিবেশ। পরিবেশ আল্লাহর মহান সৃষ্টি। মানুষের কল্যাণ ও স্বাভাবিক প্রয়োজনের তাগিদে পরিবেশের যাবতীয় উপাদান মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এর কোনোটাই অপ্রয়োজনে সৃষ্টি করা হয়নি। এ বিষয়ে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি এবং এতে পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি। আমি পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তু সুপরিমিতভাবে সৃষ্টি করেছি।’ -(সুরা হিজর ১৯) কোরআনে আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি দেখো না, নিশ্চয় আসমান ও জমিনের যা কিছু আছে সবই আল্লাহতায়ালা তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত রেখেছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।’ -সুরা লোকমান ২০

উল্লিখিত আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, দুনিয়ার সৃষ্টি এবং দুনিয়ার যাবতীয় উপাদান-উপকরণ আমাদের জন্য পরম নেয়ামত। এগুলোর সংরক্ষণ, যথাযথ ব্যবহার, যত্ন ও পরিচর্যা করা ইমানি দায়িত্বের অংশ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমরা সেই ইমানি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি। সেই দায়িত্ব পালন না করায় নানা দূষণের মাধ্যমে আজ আমরা বহুমুখী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছি। পৃথিবীর শীর্ষ দূষিত শহর ঢাকা। পরিবেশের সব উপাদান-উপকরণ একসঙ্গে দূষিত হয় ঢাকায়। তার মধ্যে ঢাকার বায়ুদূষণ অন্যতম বড় সমস্যা। ঢাকা যেন পৃথিবীর ভূ-নরকে পরিণত হতে যাচ্ছে। শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট কর্র্তৃক প্রকাশিত ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকায় বসবাসরত মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। আর সারা দেশের মানুষের কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট প্লানেটারি হেলথ জার্নালে ‘পলুশন অ্যান্ড হেলথ : আ প্রোগ্রেস আপডেট’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিভিন্ন প্রকার দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে শুধু বায়ুদূষণের কারণেই সর্বাধিক ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৫ জনের মৃত্যু হয়। দূষণজনিত মৃত্যুর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ পানিদূষণ। প্রতি বছর পানিদূষণে ৩০ হাজার ৮৭৪ জনের প্রাণহানি হয়। এ ছাড়া অন্যান্য দূষণজনিত মৃত্যুর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিসাদূষণ। সিসাদূষণের কারণে দেশে ৩০ হাজার ৭৭৭ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া অন্যান্য দূষণে মারা যায় ১০ হাজার ২৮৯ জন। অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠা, ঢাকার মতো বড় শহরের চারপাশে ইটভাটা ও কারখানা স্থাপন, শহরের প্রচুর ধুলা এবং নির্মাণকাজ বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। ট্রাফিক জ্যামের কারণে অতিরিক্ত জ্বালানি খরচও বায়ুদূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত গরম থেকে বাঁচতে মানুষ অতিরিক্ত এসি ব্যবহার করছে, তাতেও বায়ুদূষণ বাড়ছে।

বায়ুদূষণ কমাতে আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। বায়ুদূষণের হার কমাতে আমরা যেসব উদ্যোগ নিতে পারি তা হলো- অবৈধ ইটভাটা বন্ধের ব্যবস্থা, কারখানাগুলো শহরের বাইরে সরিয়ে নেওয়া, ট্রাফিক জ্যামের সমাধান, উন্নত জ্বালানি ব্যবহার, এয়ার কন্ডিশনের কম ব্যবহার, আবাসিক এলাকাগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা, যেখানে উদ্যান ও পুকুর থাকবে, নিয়ন্ত্রিতভাবে নির্মাণকাজ করা, যাতে সেটি দূষণের কারণ না হয় এবং প্রচুর বনায়ন করা। কারণ গাছ বায়ুদূষণ প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ সরকারি হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট বনভূমির আয়তন হচ্ছে প্রায় ১৭.৪ ভাগ। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী যা অর্ধেকেরও কম।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ইসলাম বৃক্ষরোপণের তাগাদা দিয়েছে। এমনকি হাদিসে বৃক্ষরোপণকে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে। বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব বুঝাতে তিনি বলেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে, কিয়ামত এসে গেছে এবং ওই মুহূর্তে গাছের চারা হাতে থাকে আর তা রোপণ করা সম্ভব হয় তাহলে তা রোপণ করে দেবে।’ -মুসনাদে আহমদ

পানিদূষণ রোধে ইসলাম সবাইকে যথেষ্ট সচেতন ও সতর্ক করেছে। পুকুরের পানি, নদীর পানি, আবদ্ধ জলাশয়ের পানি যেন দূষিত না হয়, সে জন্য রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আবদ্ধ পানি ও জলাশয়ের পানিতে তোমরা প্রস্রাব করবে না। প্রস্রাব করে তোমরা পানিকে দূষিত করে সেখানে আবার গোসল করবে না।’ -(সহিহ মুসলিম) প্রতিটি মানুষের সুস্থতার জন্য পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত পানির প্রয়োজন সর্বাগ্রে। তাই রাসুল (সা.) পানিকে পবিত্র রাখতে এবং পানিকে সংরক্ষণ করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘খবরদার! তোমরা পানির মধ্যে ফুঁ দেবে না।’ -(তিরমিজি)। এই হাদিসে খাওয়ার পানির কথা বলা হয়েছে। কারণ মানুষের নিঃশ্বাসের সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশ সিসাদূষণে চতুর্থ সর্বোচ্চ আক্রান্ত দেশ। ব্যাটারিভাঙা শিল্প, সিসাযুক্ত পেইন্ট, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল, খাবার রাখার জন্য ব্যবহৃত সিরামিকের পাত্র, ই-বর্জ্য, খেলনা, সার, রান্নায় ব্যবহৃত বিভিন্ন মসলা, প্রসাধনী, খাবার-দাবার এবং চাষ করা মাছের জন্য তৈরি খাবার থেকে বাংলাদেশে সিসার দূষণ ঘটে। সিসার দূষণরোধে প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরি করা সময়ের দাবি।

সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে বলা হয়েছে। এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি আইনও রয়েছে। যা বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০ নামে পরিচিত। এতে পরিবেশ দূষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা পাঁচ বছর জেল অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। ঢাকার পরিবেশ আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে নিষ্পন্ন হয়েছে মাত্র ২০০টি মামলা! এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে গত পাঁচ বছরে দেশে ৪ হাজার ৪৪০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। এতে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৬৬ জনকে! দূষণরোধে আইন থাকলেও তা যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। ইসলাম যেকোনো দূষণকে নিষেধ করেছে। দূষণ হয়ে গেলে প্রতিরোধ ও শোধন করার নির্দেশনা দিয়েছে। সব দূষণের মূলে মানুষ। মানুষ নষ্ট হয়ে গেছে। তাই পরিবেশ আর স্বাভাবিক থাকছে না। মানুষ শোধন হলে পরিবেশও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কেননা মানুষ যখন নষ্ট হয় তখন সে একা নষ্ট হয় না। আশপাশের পরিবেশ প্রতিবেশসহ সবকিছু নিয়েই নষ্ট হয়। এটা স্পষ্ট যে, প্রথমে দূষিত হয় মানুষ। তারপর দূষিত হয় পরিবেশ। তাই পরিবেশ দূষণরোধের আগে মানুষ দূষণরোধ জরুরি। এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

atikr2047@gmail.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION