বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ অপরাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
কক্সবাজারে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল সেখানকার তৎকালীন পুলিশ সুপার (বর্তমানে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি) এ বি এম মাসুদ হোসেনের বিরুদ্ধে। তাকে মামলার আসামি করতে আদালতে আবেদনও করেছিলেন নিহত মেজর সিনহার বোন। এ অভিযোগ ছাড়াও এসপি মাসুদের বিরুদ্ধে মাদক কারবারিদের একপক্ষকে ক্রসফায়ার, আরেক পক্ষের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া ও তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অর্থ তার নিজের ও তার স্ত্রী-সন্তানদের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব অভিযোগ অনুসন্ধান করছে। সংস্থাটির উপপরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম এ অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন।
দুদকের তথ্যমতে, এসপি মাসুদ হোসেন ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে কক্সবাজারে যোগ দেন। ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি করা হয়। ২০২৩ সালের জুন মাসে এসপি মাসুদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগ জমা হয় দুদকে। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংস্থাটির উপপরিচালক মো. ফখরুল ইসলামকে নিয়োগ দেন। তিনি অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত বছরের ৩০ জুলাই দেশের ব্যাংক, বীমা, রাজউক, সিটি করপোরেশন, রেজিস্ট্রি অফিস, ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে বলা হয়, পুলিশের কক্সবাজারের সাবেক এসপি মাসুদসহ (বর্তমানে রাজশাহী) কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ লেনদেন হওয়ায় লেয়ারিংয়ের মাধ্যমে অপরাধলব্ধ আয়ের উৎস আড়াল করাসহ মানি লন্ডারিং অপরাধ ও বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানের স্বার্থে অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট কোনো রেকর্ডপত্র থাকলে তা দুদকে পাঠানোর জন্য বলা হলো। চিঠিতে পুলিশ সুপার মাসুদ, তার স্ত্রী জেনেফার রেবেকা ও দুই সন্তানের হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে। ওই চিঠির পর কয়েকটি দপ্তর থেকে অভিযোগ-সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ দুদকে পাঠানো হয়েছে।
দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এসপি মাসুদের বিরুদ্ধে একটি অনুসন্ধান চলমান আছে। অভিযোগ তথ্য-প্রমাণ বিভিন্ন দপ্তর থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেসব রেকর্ডপত্র পাওয়া গেছে সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।
দুদকের কাছে থাকা অভিযোগে বলা হয়েছে, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের দক্ষিণ ওলানিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের আবদুল কাদের হাওলাদার ও অজুফা খাতুনের ছেলে এ বি এম মাসুদ হোসেন। তিনি ২৪তম বিসিএসে এএসপি হিসেবে যোগ দেন। তিনি স্ত্রী জেনিফার নামে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নামে-বেনামে বহু সম্পদের মালিক হয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়, কক্সবাজারে প্রায় ৩০০টি হোটেল রয়েছে। এসব হোটেল থেকে প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎকোচ নিতেন। যদি কোনো হোটেল মালিক টাকা দিতে রাজি না হতেন, তাহলে ওই হোটেলে অবৈধ কারবার পরিচালনার নামে অভিযান চালানোর হুমকি দেওয়া হতো।
অভিযোগে বলা হয়, এসপি মাসুদ কক্সবাজারে এক বছর আট মাসের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেন। তার দায়িত্বকালে মাদক কারবারিসহ ১৪৮ জন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন। এসব ক্রসফায়ারের বেশিরভাগই পরিকল্পিতভাবে দেওয়া হয়েছে। ক্রসফায়ারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও এসপির সম্পৃক্ততা ছিল। আবার পুলিশের ছত্রছায়ায় অনেক মাদক কারবারি নির্বিঘ্নে তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন। তারা মূলত পুলিশকে টাকা দিয়ে মাদক কারবার চালাতেন। মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নেওয়া টাকার একটি অংশ এসপি মাসুদ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হতো। ব্যাংক লেনদেন ছাড়াও মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থের একটি অংশ দিয়ে দেশ-বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ কেনা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যার ঘটনায় এসপি মাসুদকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করেছিলেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস। তবে সেই আবেদন খারিজ করে দেয় আদালত। সেনা কর্মকর্তা হত্যাকান্ডের পর ক্রসফায়ার বাণিজ্য ও মাদক ব্যবসায় মদদ দেওয়ার মাধ্যমে টাকা কামানোর ঘটনাটি আলোচনায় আসে। গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধান ও স্থানীয়দের ভাষ্যে উঠে আসে এসপি মাসুদের নানা অনিয়মের তথ্য। তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে ইয়াবা সরবরাহের নামে হয়রানি, মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়, মাদকবিরোধী অভিযানের নামে অর্থ আদায়, টাকার বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেওয়া, বড় মাদক কারবারিদের না ধরে চুনোপুঁটিদের ধরা এবং ক্রসফায়ার বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। তিনি মূলত কক্সবাজারের ইয়াবার নিয়ন্ত্রক। জেলাবাসী তাকে রংবাজ মাসুদ হিসেবেও চিনতেন। এসপি মাসুদের নিয়ন্ত্রণে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাসের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ৩২ সদস্যের শক্তিশালী একটি বাহিনী। ওই বাহিনীতে ছয়জন এসআই, পাঁচজন এএসআই ও তিনজন কনস্টেবল ছিল। এই বাহিনী বিশাল গাড়িবহর নিয়ে যাতায়াত এবং মাদক পাচার করত। কোটি কোটি টাকার ইয়াবা ব্যবসা হয়েছে তাদের হাত ধরে। তিনি ইয়াবা ডন হিসেবে চিহ্নিত ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ীকে কোটি টাকার বিনিময়ে আত্মসমর্পণের নামে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অন্যদিকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়েছে মাদক বহনকারী চুনোপুঁটিদের। এতে ইয়াবার স্বর্গরাজ্য কক্সবাজারে যেমন ছিল, তেমনই আছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত সোমবার বিকেলে এসপি মাসুদের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি।
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর