বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৭ অপরাহ্ন
মুফতি মাহবুব হাসান:
বিয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রাপ্তবয়স্ক দুজন নারী-পুরুষের ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। বৈধভাবে মানব বংশের ধারা অব্যাহত রাখার মাধ্যম। মানুষের পক্ষে নিঃসঙ্গভাবে একাকী জীবনযাপন করা কষ্টকর। তাই মহান আল্লাহ মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন এবং স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে ভালোবাসা ও মায়ায় আবদ্ধ করেছেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তার নিদর্শনের মধ্যে (একটি) হলো এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তার কাছে শান্তি লাভ করতে পারো। আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য, যারা চিন্তা করে।’ (সুরা রুম, আয়াত ২১) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেরূপ ভালোবাসা ও মায়া সৃষ্টি হয়, অনুরূপ ভালোবাসা ও মায়া পৃথিবীর অন্য কোনো দুই ব্যক্তির মধ্যে হয় না। এর মাধ্যমে প্রতিটি দাম্পত্য জীবন হয়ে ওঠে স্বর্গসুখের রাজ্য। যে দৃশ্য তাদের পরস্পরের পরিবারের সদস্যদেরও সুখী করে তোলে।
বর্তমান সমাজে বিয়ের বিষয়টিকে অত্যন্ত কঠিন করা হয়েছে। অথচ মানবতার ধর্ম ইসলাম বিয়েকে সহজ করার কথা বলেছে। বিয়েকে যদি কঠিন করা হয়, তাহলে সমাজে অবৈধ প্রেম, ব্যভিচার ও অন্যায় বেড়ে যাবে। কিন্তু বিয়েকে যদি সহজ করা হয় তাহলে সমাজে অবৈধ প্রেম ও ব্যভিচার কমবে এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাবে। আমাদের সমাজের কিছু পদ্ধতি নানাভাবে, নানা কায়দায় বিয়ে বিষয়টিকে কঠিন করে তুলেছে। বিয়ের কথা শুনলে বিশাল আকারের কোনো পাহাড় মাথায় জেঁকে বসে। যার কারণে একজন পুরুষকে বিয়ের কথা ভাবতে হলে তাকে অনেক কিছুর কথা চিন্তা করতে হয়। বিয়েকে কীভাবে সহজ করা যায়, সেই বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
বিয়ে মহান আল্লাহর নিদর্শন। বিয়ের আগে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মধ্যে কোনো সম্বন্ধ থাকে না। কিন্তু বিয়ের পর তাদের মধ্যে এমন অদৃশ্য গভীর বন্ধন ও ভালোবাসা গড়ে ওঠে; তারা অতীত জীবনকে ভুলে গিয়ে সম্পূর্ণরূপে একে অন্যের হয়ে যায়। এখন আর একজন অন্যজন ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না। যৌবনকালে না হয় এ ভালোবাসার পেছনে জৈব তাগিদের কোনো ভূমিকাকে দাঁড় করানো যাবে। কিন্তু বৃদ্ধকালে কোন সে তাড়না এ ভালোবাসাকে স্থিত রাখে? তখন তো দেখা যায়, একের প্রতি অন্যের টান ও মমতা আরও বৃদ্ধি পায়।
বিয়ের ক্ষেত্রে বড় আয়োজন বর্জন করতে হবে। আমাদের সমাজের অনেকেরই ধারণা, বিয়ে করতে গেলে বিশাল বড় আয়োজন করতে হবে। যদি বড় আয়োজন না করে তাহলে মানুষ কী বলবে, লোকেরা কী ধারণা করবে! চক্ষুলজ্জায় হলেও সাধ্যের বাইরে গিয়ে আয়োজন করতে হবে। এমন মনমানসিকতা কমবেশি সবাই লালন করে। হাদিসে অলিমার কথা এসেছে। অলিমার ব্যবস্থা সাধ্য অনুযায়ী মানুষ আয়োজন করবে। লোক দেখানোর জন্য অলিমা করবে না। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বিয়ের প্রথম দিনের ভোজের ব্যবস্থা করা আবশ্যকীয়, দ্বিতীয় দিনের ভোজের ব্যবস্থা করা সুন্নত এবং তৃতীয় দিনের ভোজ হলো নাম-ডাক ছড়ানোর উদ্দেশে। যে ব্যক্তি নাম-ডাক ছড়াতে চায়, (কেয়ামতের দিন) আল্লাহ তাকে তদ্রƒপ (অহংকারী ও মিথ্যুক হিসেবে) প্রকাশ করবেন। (তিরমিজি)
বিয়ের ক্ষেত্রে বিপুল অর্থের মোহর নির্ধারণ না করা। বিয়ে কঠিন হওয়ার আরেকটি অন্যতম বড় কারণ হলো, অধিক মোহর নির্ধারণ করা। অথচ শরিয়ত নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে অধিক মোহর নির্ধারণ করাকে কোনোক্রমেই পছন্দ করে না। আবুল আজফা আস-সুলামি (রহ.) বলেন, একবার ওমর (রা.) আমাদের উদ্দেশে ভাষণে বলেন, সাবধান! তোমরা নারীদের মোহর নির্ধারণে সীমালঙ্ঘন কোরো না। কারণ যদি তা দুনিয়ায় মর্যাদার বস্তু হতো এবং আল্লাহর কাছে পরহেজগারির বস্তু হতো, তাহলে তোমাদের চেয়ে রাসুল (সা.) হতেন এর যোগ্যতম ব্যক্তি। অথচ তিনি তার স্ত্রীদের কারও মোহর এবং তার কন্যাদের কারও মোহর ১২ উকিয়ার বেশি ধার্য করেননি। (সুনানে আবু দাউদ) টাকার হিসাবে ১২ উকিয়ার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর বেশি যারা মোহর নির্ধারণ করেন তারা মূলত বিয়েকে কঠিন করে তুলেন। ইসলামের একটি সহজ বিষয়কে কঠিন করতে যারা মরিয়া, তাদের বিষয়ে কথা হলো, পরকালে এর জন্য কঠিন বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।
এছাড়া অনেক পরিবারেই দেখা যায়, ছেলেরা নিজের ক্যারিয়ার অনেক উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিয়েতে যথেষ্ট বিলম্ব করে থাকেন। আবার অনেক অভিভাবক তাদের মেয়েকে সরকারি চাকরিজীবী পাত্র না পাওয়ায় বিয়ে দিতে বিলম্ব করেন। আর এদিক দিয়ে মেয়ের বয়স বাড়তে বাড়তে মধ্য বয়সে পৌঁছে যায়। তারা উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী পাওয়ার পরও বিয়ে দিতে চান না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা যে ব্যক্তির দ্বীনদারি ও নৈতিক চরিত্রে সন্তুষ্ট, তোমাদের কাছে সে ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব করলে তবে তার সঙ্গে বিয়ে দাও। তা যদি না করো তাহলে পৃথিবীতে ফেতনা-ফাসাদ ও চরম বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। (তিরমিজি)
আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাদের বিশ্বাস, বিয়ে করলে অভাব বেড়ে যাবে। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত, তাদের বিয়ে সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসিদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ণ, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নুর ৩২)
এ আয়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে যদি বিয়ের উপযুক্ত হয়, তবে অভিভাবকদের উচিত তাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা। বিয়ের পর কেউ স্ত্রী ও সন্তানদের ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে অভাবে পড়তে পারে, এই আশঙ্কায় বিয়ে বিলম্বিত করা সমীচীন নয়। চরিত্র রক্ষার উদ্দেশে আল্লাহর ওপর ভরসা করে বিয়ে দিলে ব্যয় নির্বাহের জন্য মহান আল্লাহ উপযুক্ত কোনো ব্যবস্থা করে দেবেন। ইবনে মাসউদ বলতেন, তোমরা যদি ধনী হতে চাও, তবে বিয়ে করো। (মারেফুল কোরআন)
ভয়েস/আআ