বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০১:৪২ পূর্বাহ্ন
হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর:
মুসলমানদের মধ্যে একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে যে বাক্যের মাধ্যমে পারস্পরিক সম্ভাষণ জানানোর বিধান ও ঐতিহ্য রয়েছে, তা হলো সালাম তথা ‘আসসালামু আলাইকুম।’ এর অর্থ ‘আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব, সেহেতু সামাজিক বন্ধন ও ভ্রাতৃত্ববোধ অটুট রাখার জন্য ইসলাম একে অন্যের প্রতি সম্ভাষণ জানানোর এমন চমকপ্রদ বাক্য ও পদ্ধতি শিখিয়েছে, যা অপরিচিত মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি করে। আর পরিচিত ব্যক্তির সম্পর্ককে করে অধিকতর সুদৃঢ়। শুধু তাই নয়, ইসলামের এই অভিবাদন পদ্ধতি পারস্পরিক মনোমালিন্য ও শত্রুতার মনোভাব দূর করে সম্প্রীতি এবং বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে। সালামের মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে পড়ে শান্তি-সম্প্রীতির আলো। সর্বোপরি ইসলামের রীতি মোতাবেক পারস্পরিক যে সালাম বিনিময় হয়, তা গতানুগতিক ও অন্তঃসারশূন্য কোনো অভিবাদনসূলভ বাক্য নয়; বরং সালাম হচ্ছে একে অন্যের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা কামনায় বিশেষ দোয়া। যাতে রয়েছে আল্লাহতায়ালার কাছে অবারিত শান্তি, অফুরন্ত রহমত ও বরকত লাভের অনন্য আবেদন।
সালামের গুরুত্ব : পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে, নবী! আমার আয়াতের ওপর ইমান রাখে এমন লোকরা যখন আপনার দরবারে আগমন করে তখন আপনি তাদের বলুন, তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ (সুরা আনআম ৫৪) এ আয়াতে রাসুল (সা.)-কে সম্বোধন করে উম্মতকে এ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, যখন এক মুসলমান অন্য মুসলমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে তখন উভয়েই বন্ধুত্ব ও আনন্দ-আবেগ প্রকাশ করবে একে অন্যের জন্য শান্তি ও রহমত কামনার মাধ্যমে।
সালামের ফজিলত : রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সাক্ষাতের সময় ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলবে, তার আমলনামায় ১০টি নেকি লেখা হবে। যে ব্যক্তি ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলবে তার আমলনামায় ২০টি নেকি লেখা হবে। আর যে ব্যক্তি ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ’ বলবে তার আমলনামায় ৩০টি নেকি লেখা হবে। (তাবারানি) অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, সেই ব্যক্তি আল্লাহর সর্বাধিক নিকটবর্তী, যে প্রথমে সালাম দেয়। (আবু দাউদ) রাসুল (সা.) ছোট-বড় সবাইকে আগে আগেই সালাম দিতেন। এমনকি নিজের কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.)-কেও তিনি আগে সালাম দিতেন। এখন অনেকে সালাম নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন, সালাম দিতে অভ্যস্ত নন। তারা বয়সে বা মর্যাদায় ছোটদের সালাম করাকে মর্যাদাহানি বলে মনে করেন। অথচ পূর্বোক্ত হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সালাম দেওয়ার ক্ষেত্রে ছোট-বড়, ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ নেই। সমগ্র সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠত্ব ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছোট-বড় সবাইকে সর্বাগ্রে সালাম দিয়ে সেই শিক্ষাই দিয়েছেন।
জীবনে সালামের প্রভাব : অহংকার, শত্রুতা, বিদ্বেষ ও বিচ্ছেদের কালো ছায়ায় আজ পুরো পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন। সালামের প্রসারের মাধ্যমেই এই কালো ছায়া অপসারণ করে সমাজকে শান্তি-সম্প্রীতির আলোয় উদ্ভাসিত করা সম্ভব। কারণ সালাম ভালোবাসা সৃষ্টি করে, সামাজিক সম্প্রীতি ও মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলে। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা সালামের ব্যাপক প্রসার ঘটাবে। যাতে করে তোমাদের মধ্যে উত্তরোত্তর ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। (তাবারানি) অনুরূপভাবে সালাম অহংকারমুক্ত সমাজ ও ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রকৃষ্ট অবলম্বন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আগে সালাম দেয় সে অহংকারমুক্ত। (বায়হাকি)
সালামের বিধান : একজন মুসলমানের সঙ্গে আরেকজন মুসলমানের সাক্ষাৎ হলে প্রথমেই সালাম বলে সম্ভাষণ জানানো ইসলামের বিধান এবং রাসুল (সা.)-এর পবিত্র সুন্নত। আর সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। রাসুল (সা.) পারস্পরিক সাক্ষাতে সালামের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, যখন কোনো মুসলমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তখন তাকে সালাম জানাবে। (মিশকাত)
সালামের মাধ্যমে অনুমতি : সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে একে অন্যের বাড়িঘরে যেতে হয়। আর এজন্য বাড়ির অধিবাসীর অনুমতি লাভ অবশ্যই জরুরি। অন্যথায় পারস্পরিক মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়, যা সামাজিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই অন্যের বাড়িতে প্রবেশের প্রয়োজন হলে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সালাম দেওয়ার মাধ্যমে অনুমতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের ঘর ছাড়া অন্য কারও ঘরে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই ঘরের অধিবাসীর সম্মতি লাভ করবে এবং তাদের সালাম দিবে। এটিই তোমাদের জন্য উত্তম। এসব বলা হয় যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’ (সুরা নুর ২৭)
নিজ ঘরে প্রবেশের সময় সালাম : সবাই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মায়া-মমতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকতে চাই। কামনা করি পরিবারের জন্য শান্তি, কল্যাণ ও বরকত। আর পারিবারিক বন্ধন সুসংহতকরণ এবং পরস্পরের জন্য রহমত ও বরকত কামনা করার উৎকৃষ্ট পন্থা হলো সালাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যখন তোমাদের ঘরে প্রবেশ করবে, তখন তোমাদের পরিবারবর্গ ও আপনজনদের প্রতি সালাম প্রদান করবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষা দেওয়া সালাম উত্তম অভিবাদন বরকতময় ও পবিত্র।’ (সুরা নুর ৬১) একদিন রাসুল (সা.) হজরত আনাস (রা.)-কে বললেন, হে বৎস, যখন তুমি তোমার ঘরে পরিবার-পরিজনের কাছে প্রবেশ করবে, তখন তুমি সালাম বলবে। এতে তোমার ও তোমার পরিবারের সবার জন্য বরকত নিহিত রয়েছে। (তিরমিজি)
মজলিসে আসা-যাওয়ার সময় : কোনো সভা, মজলিস, অনুষ্ঠানে যোগদান ও বিদায় নেওয়ার সময় সালাম দেওয়া ভদ্রতা ও সৌজন্যতার পরিচায়ক। এতে করে সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন অধিকতর সুদৃঢ় হয়। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ কোনো মজলিসে এলে সে যেন সালাম দেয়। এরপর সে মজলিস ত্যাগ করতে চাইলেও যেন সালাম দিয়ে চলে যায়। (আবু দাউদ)
চিঠিপত্রের শুরুতে সালাম : চিঠিপত্রের মাধ্যমে কুশল বিনিময় ও প্রয়োজনীয় খবর পাঠানোর রীতি অতি প্রাচীন। এ ক্ষেত্রেও সালামের মাধ্যমে পারস্পরিক কল্যাণ কামনা করা যায়। রাসুল (সা.) সেই আদর্শ আমাদের জন্য রেখে গেছেন। তিনি রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত সংবলিত চিঠিতে সালাম দিয়েছিলেন। যার ভাষা ছিল এ রকম, ‘সালামুন আলা মানিত্তাবাআল হুদা’ অর্থ্যাৎ যে ব্যক্তি হেদায়তের অনুসরণ করবে তার প্রতি সালাম তথা শান্তি বর্ষিত হোক।
মোবাইল ফোনে সালাম : তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সুবাদে এখন মোবাইল ফোনেই প্রায়ই পরস্পরের আলোচনা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেও আগে সালাম দিয়ে আলাপ শুরু করা উত্তম। কারণ সালামের আগে কথা বলা সুন্নত পরিপন্থী। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, কথা বলার আগেই সালাম জানাতে হয়। (তিরমিজি) কিন্তু এখন মোবাইল বা টেলিফোনে যোগাযোগের সময় ‘হ্যালো’ বলার পর সালাম দেওয়া বা একেবারেই সালাম না দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আসুন, এ প্রবণতা পরিহার করে সালামের পর আলোচনা শুরু করতে অভ্যস্ত হই।
ভয়েস/আআ