শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ০৫:৪৫ পূর্বাহ্ন
মো. আবদুর রহমান:
অল্প ইবাদতে বেশি সওয়াব
রমজান মাসের ইবাদতে অন্য মাসের তুলনায় অধিক সওয়াব দেওয়া হয়। এ মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল ইবাদত করে সে অন্য মাসের একটি ফরজ আদায়ের সমপরিমাণ সওয়াব পায়। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করে, সে অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায়ের সওয়াব লাভ করে। সুতরাং অল্প ইবাদতে অধিক সওয়াব অর্জনের মাস রমাজন। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, রোজাদারের নিদ্রা ইবাদতের সমতুল্য, তার নীরবতা তসবিহ পাঠের সমতুল্য, সে সামান্য ইবাদতে অন্য সময় অপেক্ষা অধিকতর সওয়াবের অধিকারী হয়, তার দোয়া কবুল এবং গুনাহ মাফ হয়। আর রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ মহান আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও অধিক সুগন্ধিময় বলে বিবেচিত হয়। এ মাসে উদারহস্তে দান-সদকা করতে রাসুল (সা.) উৎসাহ প্রদান করেছেন। রমজান মাসের একটি মুহূর্তও যাতে বেকার না যায়, সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখা কাম্য।
তাই প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে বাকি সময় তাসবিহ-তাহলিল ও কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যে নিমগ্ন থাকাই প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ।
এ মাসে ইতিকাফ করা খুবই পুণ্যের কাজ। ইতিকাফ একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো স্থির থাকা বা অবস্থান করা। পরিভাষায় ইতিকাফ হলো, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায় শর্তসাপেক্ষে নিয়তসহ পুরুষদের মসজিদে অবস্থান করা, যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা হয়। আর মহিলাদের জন্য ইতিকাফের নিয়তসহ ঘরের ভেতর সুনির্দিষ্ট কোনো স্থানে অবস্থান করা। রমজানের শেষ দশক (২০ রমজান সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা পর্যন্ত) ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা কিফায়া। বিনা প্রয়োজনে অর্থাৎ গোসল, খাবার, প্রস্রাব-পায়খানা ছাড়া অন্য কোনো অজুহাতে ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করা যাবে না। ইতিকাফ অবস্থায় অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করে নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, ইসতেগফার, দোয়া, দরুদ পাঠ, নফল নামাজ এসব ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতে হবে।
রমজান মাসে কোরআন নাজিল শুরু হয়েছে। এ মাসকে বলা হয় কোরআনের মাস। তাই এ মাসে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা কাম্য। যারা কোরআন তেলাওয়াত করতে পারেন না, তাদের তেলাওয়াত শেখা খুবই জরুরি। জানি না বলে বাঁচার উপায় নেই, যেহেতু কোরআন নাজিলের প্রথম কথাটি ছিল ‘ইকরা’ অর্থাৎ অধ্যয়ন করো, তাই কোরআন পাঠ ও অর্থ বুঝে সে অনুযায়ী আমল করার প্রতি আগ্রহশীল হওয়া প্রত্যেক মুসলমানদের ইমানি দায়িত্ব। এজন্য রমজান মাসে অধিক নফল নামাজ ও অধিক কোরআন তেলাওয়াতের অধ্যয়ন জরুরি যা একজন মুমিনকে সঠিক মুত্তাকিরূপে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। রাসুল (সা.) সিয়াম সাধনায় প্রবৃত্তি নিবৃত্তির সঙ্গে আত্মশক্তিকে জাগ্রত করার জন্য রাত জেগে কোরআন অধ্যয়নের সাধনাকে অবলম্বন করার জন্য জোর দিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন রোজা এবং কোরআন আল্লাহর কাছে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনা থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। তিনি বলেন, এরপর উভয়ের সুপারিশই গ্রহণ করা হবে।’(মুসনাদে আহমাদ)
হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে, প্রত্যেক বস্তুর একটি দরজা রয়েছে। আর ইবাদতের দরজা হলো রোজা। অনেকে অবশ্য ভুল করে মনে করে যে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু না খাওয়া বা কিছু পান না করাকেই রোজা বলে। কিন্তু তারা জানে না যে, কেবল ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকার নামই রোজা নয়। এগুলো রোজার বাহ্যিক রূপ মাত্র। রাসুল (সা.) রোজার প্রকৃত উদ্দেশের প্রতি নানাভাবে ইঙ্গিত করে এ কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, রোজার মর্মার্থ উপলব্ধি না করে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকার আদৌ কোনো সার্থকতা নেই। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলা ও অন্যায় কাজকর্ম পরিত্যাগ করবে না তার শুধুমাত্র পানাহার পরিত্যাগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। (সহিহ বুখারি) এ ধরনের হতভাগ্য রোজাদারদের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, অনেক রোজাদার এমন আছে কেবল ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া যাদের ভাগ্যে অন্য কিছু জোটে না। তেমনি রাতে ইবাদতকারী এমন অনেক মানুষ আছে যারা রাত জেগে থাকা ছাড়া আর কিছুই লাভ করতে পারে না।
হাদিসের এ দুটি ভাষ্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ক্ষুধা ও পিপাসা প্রকৃত ইবাদতের অবলম্বন মাত্র। আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহর আইন ভঙ্গের অপরাধ থেকে বিরত থাকা, আল্লাহকে ভালোবেসে যে কাজে তার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় এবং স্বীয় আমিত্বকে দমন করা যায় সেসব কাজ ঐকান্তিক আগ্রহের সঙ্গে করাই প্রকৃত ইবাদত।
সিয়াম সাধনার নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় উপকারের পাশাপাশি পার্থিব কল্যাণও উপেক্ষা করার মতো নয়। সেদিকে লক্ষ করলে রোজা শুধু ইবাদতই নয়, মানব কল্যাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও বটে। রমজানের শিক্ষাকে যদি আমরা প্রকৃত অর্থে হৃদয়ে ধারণ করতে পারি এবং সব কর্মকাণ্ডে অনুসরণ করি, তাহলে তা হবে আমাদের জীবনে মাহে রমজানের সাধনার যথার্থ প্রতিফলন। আমাদের প্রত্যাশা সিয়াম সাধনার কল্যাণে আমরা শুদ্ধ হব, নির্মল হব এবং আল্লাহর রহমত লাভে সমর্থ হব। আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে রমজানের চিরন্তন চেতনার যথার্থ প্রতিফলন হবে, এটাই একান্ত কামনা।
ভয়েস/আআ