শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০১:০০ পূর্বাহ্ন
ধর্ম ডেস্ক:
পৃথিবীর পুরনো জাতি ইহুদি। মহান আল্লাহ তাদের মাঝে অনেক নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। তাদের কিতাবও দিয়েছেন। তাই তাদের বলা হয় আহলে কিতাব। আহলে কিতাবদের মধ্যে ভালো-মন্দ সব শ্রেণির মানুষই ছিল। তাদের মধ্যে যারা হেদায়েতপ্রাপ্ত ও নেক ছিল, তারা নিজ নবীর আনা কিতাব ও শরিয়ত মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিল এবং নবীর বিদায়ের পরও তার শরিয়তের ওপর অটল ছিল। তারা মুসা (আ.)-এর ওপর এবং তার প্রতি নাজিলকৃত কিতাব তাওরাতের প্রতি ইমান এনেছিল। এরপর হজরত ইসা (আ.)-এর আগমনের পর তাকেও খোলামনে গ্রহণ করেছিল।
তবে সেই জাতির অধিকাংশ সত্য জানার পরও হঠকারিতা ও বিদ্বেষবশত তা গ্রহণ করেনি। বিদ্বেষ ও হঠকারিতার কারণে তাদের ওপর আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছিল। মহান আল্লাহর কুদরত, নেয়ামত ও আজাব সরাসরি প্রত্যক্ষ করার পরও তারা শিক্ষা নেয়নি। নিজেদের অন্যায়-অনাচার ও দুশ্চরিত্রের ফলে আল্লাহর রহমত থেকে ছিটকে পড়েছিল। কুফর, শিরক, অন্যায়-অনাচারে তারা সব সীমা অতিক্রম করেছিল। বহু নবীকে তারা হত্যা করেছিল।
তাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যই হলো সত্য গোপন করা, নবীদের বিরুদ্ধাচারণ করা, বিশেষ করে ইসলাম ও ইসলামের নবী এবং মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করা, ইসলামের বিরুদ্ধে কঠিন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা, ওয়াদা ও চুক্তিভঙ্গ করা, বিশ্বাসঘাতকতা, খেয়ানত ও গাদ্দারি, খুন-খারাবি, পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি, যুদ্ধ-বিগ্রহ জিইয়ে রাখা, অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ গ্রাস করাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তারা করেনি বা বর্তমানেও করছে না।
কোরআনের একাধিক স্থানে মহান আল্লাহ বিভিন্ন আঙ্গিকে তাদের চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এখানে কোরআনে বর্ণিত তাদের চরিত্রের মৌলিক কিছু দিক উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহর সঙ্গে বেয়াদবি : জাকাতের বিধান নাজিল হওয়ার পর তারা ব্যঙ্গ করে বলেছিল, ‘আল্লাহ দরিদ্র আর আমরা ধনী।’ মহান আল্লাহ তাদের এমন চরম বেয়াদবির কোনো উত্তর না দিয়ে বরং শাস্তির সতর্কবাণী শুনিয়ে দিয়েছেন এভাবে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন, যারা বলেছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ দরিদ্র এবং আমরা ধনী। অচিরেই আমি লিখে রাখব তারা যা বলেছে এবং নবীদের তাদের অন্যায়ভাবে হত্যার বিষয়টিও এবং আমি বলব, তোমরা উত্তপ্ত আজব আস্বাদন করো।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৮১)
অবাধ্যতার কারণে মহান আল্লাহ কিছুদিন তাদের অর্থসংকটে পতিত করেন। এ অবস্থায় তাদের উচিত ছিল আনুগত্য স্বীকার করা। এ ছাড়া মহান আল্লাহ তাদের দীর্ঘদিন সিনাই মরুভূমিতে ছন্নছাড়া জীবনযাপন করিয়েছেন। সেখানে তাদের বিভিন্ন ধরনের কষ্ট হচ্ছিল, যদিও অনেক অলৌকিক নেয়ামতও তখন তাদের ওপর নাজিল করা হয়েছে। এ থেকে মুক্তি দিয়ে মহান আল্লাহ যখন তাদের বললেন, নতশির হয়ে অমুক জনপদে প্রবেশ করো আর বলো, ‘আল্লাহ, আমরা ক্ষমা চাই, আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন।’ (সুরা বাকারা : ৫৮-৫৯)। কিন্তু তারা আল্লাহর সঙ্গে মশকরা শুরু করে দিল। তারা স্লোগান দেওয়া শুরু করল, ‘গম চাই! গম চাই!’ (সহিহ বোখারি : ৪৬৪১)
নবীদের বিরুদ্ধাচারণ : ইহুদিরা আল্লাহর প্রেরিত নবীদের হত্যা করেছে। নবীরা যখন শরিয়তের কোনো বিধান নিয়ে এসেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে, তাদের মনঃপূত না হলেই হয়তো দাম্ভিকতা দেখিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে, নয়তো নবীকেই হত্যা করে ফেলেছে। এমনই ছিল ইহুদিদের পূর্বপুরুষদের চরিত্র। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর এটা কেমন আচরণ যে, যখনই কোনো রাসুল তোমাদের কাছে এমন কোনো বিষয় নিয়ে উপস্থিত হয়েছে, যা তোমাদের মনের চাহিদা সম্মত নয়, তখনই তোমরা দম্ভ দেখিয়েছ? অতএব কতক (নবী)-কে তোমরা মিথ্যাবাদী বলেছ এবং কতককে হত্যা করছ।’ (সুরা বাকারা : ৮৭)
ফ্যাসাদ সৃষ্টি : ইহুদিদের স্বভাব হলো পৃথিবীতে যুদ্ধ-বিগ্রহ, খুন-খারাবি ও অনাচার সৃষ্টি করে যাওয়া। অন্যদের মধ্যে শত্রুতা লাগিয়ে দেওয়া এবং তা জিইয়ে রাখা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা যখনই যুদ্ধের আগুন জ্বালায়, আল্লাহ তা নিভিয়ে দেন। তারা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তার করে বেড়ায়, অথচ আল্লাহ অশান্তি বিস্তারকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা মায়েদা : ৬৪)
প্রতারণা : ওয়াদা ও চুক্তিভঙ্গ, খেয়ানত ও গাদ্দারি, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত এবং গুপ্ত ফন্দি তাদের জীবনের অংশ। এই জাতির চরিত্রই হলো চুক্তিভঙ্গ করা। কোরআনে এ বিষয়ে অসংখ্য ঘটনা ও বিবরণ উল্লিখিত হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘(এটা কেমন আচরণ যে) যখনই তারা কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সর্বদা তাদের একটি দল তা ভেঙে ছুড়ে ফেলেছে। তাদের অধিকাংশই ইমান আনে না।’ (সুরা বাকারা : ১০০) অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘(তারা) সেই সব লোক, যাদের থেকে আপনি প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তারা প্রতিবার নিজ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং তারা বিন্দুমাত্র ভয় করে না।’ (সুরা আনফাল : ৫৬)
কঠিন অন্তর : চুক্তি ভঙ্গের মতো গুরুতর অপরাধের কারণে আল্লাহ তাদের অভিশাপও দিয়েছেন। কঠিন করে দিয়েছেন তাদের অন্তরকেও। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণেই তো আমি তাদের আমার রহমত থেকে বিতাড়িত করি ও তাদের অন্তর কঠিন করে দিই। তারা (তাওরাতের) বাণীসমূহকে তার আপন স্থান থেকে সরিয়ে দেয়। তাদের যে বিষয়ে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল তার একটি অংশ ভুলে যায়।’ অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের অন্তর আবার শক্ত হয়ে গেল, এমনকি তা হয়ে গেল পাথরের মতো বরং তার চেয়েও বেশি শক্ত। (সুরা বাকারা : ৭৪)
কাপুরুষ : ইহুদিরা কাপুরুষ। তারা আল্লাহর চেয়ে মুসলিম উম্মাহকে বেশি ভয় পায়! মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে মুসলিমগণ!) প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তরে আল্লাহর চেয়ে তোমাদের ভয়ই বেশি। তা এজন্য যে, তারা এমনই এক সম্প্রদায়, যাদের বুঝ-সমঝ নেই।’ (সুরা হাশর : ১৩) এখনো দেখা যায়, কথিত বড় সামরিক শক্তি হওয়া সত্ত্বেও নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের প্রতি তারা এত ভীত!
আমানতের খেয়ানত : ইহুদিদের স্বভাব হলো আমানতের খেয়ানত করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আহলে কিতাবদের কিছু লোক, যাদের কাছে একটি দিনারও যদি আমানত রাখা হয়, তা সে আর ফেরত দেবে না, যদি না তুমি তার মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাক। তাদের এ কর্মপন্থা এ কারণে যে, তারা বলে থাকে, উম্মিদের (অইহুদি আরবদের) ব্যাপারে আমাদের থেকে কোনো কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে না। আর (এভাবে) জেনেশুনে তারা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যাচার করে।’ (সুরা আলে ইমরান : ৭৫)
চির লাঞ্ছিত : যতদিন ইহুদিরা তাদের মন্দ স্বভাব পরিত্যাগ করে ইমান ও ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে না আসবে, এ পৃথিবীতে লাঞ্ছনা ও অপদস্থতা ছায়ার মতোই তাদের সঙ্গে লেগে থাকবে। এটা আল্লাহর ঘোষণা। অবশ্য আল্লাহর তরফ থেকে যদি কোনো উপায় সৃষ্টি হয়ে যায় কিংবা মানুষের পক্ষ হতে কোনো অবলম্বন পাওয়া যায়, যা তাদের পোষকতা দান করবে, তবে ভিন্ন কথা। যেমন আজ পোষকতা পাচ্ছে পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে।
এই পৃষ্ঠপোষকতা মুহূর্তের জন্য সরে গেলেই এরা সর্বহারা। এদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির ঘোষণা। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের যেখানেই পাওয়া যাক, তাদের ওপর লাঞ্ছনার ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছে, অবশ্য আল্লাহর তরফ থেকে যদি কোনো উপায় সৃষ্টি হয়ে যায় কিংবা মানুষের পক্ষ হতে কোনো অবলম্বন বের হয়ে আসে, (যা তাদের পোষকতা দান করবে) তবে ভিন্ন কথা। তারা আল্লাহর ক্রোধ নিয়ে ফিরেছে, আর তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে অভাবগ্রস্ততা। এর কারণ এই যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করত এবং নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করত। (তাছাড়া) এর কারণ এই যে, তারা অবাধ্যতা করত ও সীমালঙ্ঘনে লিপ্ত থাকত। (সুরা আলে ইমরান : ১১২)
ভয়েস/আআ