মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:১৬ অপরাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে অস্থিরতা। সেইসঙ্গে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধ। মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসা, চোরাচালান, মানব পাচার, অপহরণ ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গাদের একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ। এসব নিয়ে গত আট বছরে খুন হয়েছেন ৩০০ জন রোহিঙ্গা নাগরিক। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিটি নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গা। পাশাপাশি গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি আগস্ট পর্যন্ত ক্যাম্পগুলোতে বেড়েছে শতাধিক মাদকের আখড়া।
জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আট মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১০ ধরনের অপরাধের বিপরীতে ২৫০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ১৮টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদক ও অপহরণের। মাদকের মামলা ১৫০টি। একইসঙ্গে অপহরণের ৫০টি, ধর্ষণের ১২টি মামলা হয়েছে। সবমিলিয়ে ২০১৭ সাল থেকে গত আট বছরে তিন শতাধিক খুনের ঘটনায় ২৮৭টি মামলা হয়েছে।
ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলছেন, মানব পাচার, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও একাধিক গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের জেরে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড ঘটছে। আবার অপহরণ করে চাঁদা না পাওয়ায় কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সন্ত্রাসীরা। বর্তমানে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। ইয়াবা ব্যবসা, মানব পাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে হামলা, সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে। চলছে অস্ত্রের মহড়াও। এতে অপহরণ, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের মতো নানা অপরাধ বাড়ছে।
১০টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয়
জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ১০ গ্রুপ সক্রিয় আছে। আগে ১৪টির মতো ছিল। এর মধ্যে অনেক গ্রুপের প্রধানসহ সহযোগীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা এখনও রয়েছে তারা ক্যাম্পের ভেতরে অপরিকল্পিতভাবে দোকানপাট ও মাদক বিক্রির আখড়া তৈরি, মানব পাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়েও তাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
পুলিশসহ স্থানীয় একাধিক সূত্রমতে, টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০টির বেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আছে। এর মধ্যে টেকনাফের আবদুল হাকিম বাহিনী বেশি তৎপর। এই বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য যখন-তখন লোকজনকে অপহরণ করে। মুক্তিপণ না পেলে হত্যা করে লাশ গুম করে। ইয়াবা, মানব পাচারে যুক্ত থাকার পাশাপাশি এ বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা নারীদের তুলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটায়।
বেড়েছে অপহরণ ও মাদক ব্যবসা
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, প্রথমদিকে আরসা নিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভিন্ন মত থাকলেও ক্যাম্পের দুই রোহিঙ্গা নেতা, তিন মাঝি ও ছয় মুসল্লিসহ দুই ডজন খুনের ঘটনায় আরসা জড়িত বলে জেনে যান তারা। তবে চলতি বছরের মার্চ মাসে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ ওরফে আবু আম্মার জুনুনীসহ ১০ জনকে গ্রেফতারের পর ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড আগের তুলনায় কমেছে। কিন্তু অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, মানব পাচার ও মাদক ব্যবসা বেড়েছে।
রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক বছরে (গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি আগস্ট) রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শতাধিক মাদক বিক্রি ও সেবনের আখড়া গড়ে উঠেছে। ইয়াবা মজুতের জন্যও ব্যবহার হচ্ছে ক্যাম্পগুলো। সরকার পরিবর্তনের পর ক্যাম্পগুলোতে অভিযান কমে যাওয়ার সুযোগে এগুলো গড়ে উঠেছে। সবগুলো ক্যাম্পে বর্তমানে চার শতাধিক মাদক বিক্রি ও সেবনের আখড়া রয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচাতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে বর্তমান নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। ইতিমধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে গত জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে গত জুন পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছেন এক লাখ ২১ হাজার। আর অন্যরা নিবন্ধন ছাড়াই ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছেন। নতুন করে আসা এসব রোহিঙ্গার বেশিরভাগই নারী-শিশু। সবমিলিয়ে ১৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। কিন্তু গত আট বছরে একজনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। উল্টো সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে এখনও। পাশাপাশি প্রতি বছর ক্যাম্পে ৩০ হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে। সবমিলিয়ে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে নিয়ে এখন আর্থসামাজিক চাপে বাংলাদেশ। বিষয়টি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সভাপতি মোহাম্মদ জুবায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগের বছরগুলোর তুলনায় হত্যাকাণ্ড একটু কমলেও মাদক-অপহরণের ঘটনা বেড়েছে। প্রায় দিন মাদক-অপহরণের ঘটনা শোনা যাচ্ছে। ফলে ক্যাম্পের বাসিন্দারা ভয়ভীতির মধ্যে আছেন। এগুলোর একমাত্র সমাধানের পথ প্রত্যাবাসন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে না।’
অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়
গত রবিবার টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথা হয় কালা মিয়ার সঙ্গে। তার বাড়ি ছিল রাখাইনের মংডু থানার বলিরবাজার এলাকায়। কালা মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ২৬ মে কুতুপালং যাওয়ার পথে চার জন লোক আমাকে থামতে ইশারা দিলে দাঁড়াই। পরে তারা আমাকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। কীভাবে নিয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম না। পরদিন সকালে দেখি আমি কুতুপালং ক্যাম্পের ঝুপড়ি ঘরে।’
কথা বলতে বলতে পিঠ, হাতের ওপরের অংশ এবং পায়ের ক্ষত দেখিয়ে কালা মিয়া বলেন, ‘তারা গলায় ছুরি ধরে বাড়িতে ফোন করাতো। ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিল। কোনও উপায় না পেয়ে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে দুদিন পর ছাড়া পেয়েছি। ওই দুদিন আমাকে অনেক নির্যাতন করেছিল তারা। এসব অপহরণের ঘটনায় জড়িত বিভিন্ন ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের এমন ১০টির বেশি গ্রুপ সক্রিয় আছে। পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোতে আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে মাদক বিক্রি ও সেবনের আখড়া।’
সম্প্রতি একই ক্যাম্পের বাসিন্দা সাবের আলম অপহরণের শিকার হয়ে ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন। তিনি বাংলাদেশে এসেছেন রাখাইনের ঢেঁকিবুনিয়া থেকে। অপহরণকারীদের চিনতে পেরেছেন কিনা জানতে চাইলে সাবের আলম বলেন, ‘তারা রোহিঙ্গা। দেখেই বোঝা যায়, সন্ত্রাসী গ্রুপের।’
পুলিশ বলছে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে জোর তৎপরতা আছে
তবে ক্যাম্পে হত্যা, অপহরণ ও মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের জোর তৎপরতা রয়েছে বলে জানালেন ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক পুলিশ সুপার রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৩টি ক্যাম্পে প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গার বসতি। সে হিসাবে আমাদের সদস্য সংখ্যা অপ্রতুল। তবু আমরা রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছি। ফলে ক্যাম্পের পরিস্থিতি শান্ত আছে।’
আমাদের জোর তৎপরতা থাকায় আগের তুলনায় ক্যাম্পে খুনের ঘটনা কমেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।’
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ক্যাম্পগুলো থেকে অর্ধলাখ ইয়াবাসহ ১১৬ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময়ে উখিয়া ও টেকনাফ থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে ৬৫টি। পাশাপাশি গত ১৮ মাসে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০০ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অনেককে উদ্ধার করা হয়েছে। আবার কেউ মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত এসেছেন। অনেকে অপহরণ হলেও পুলিশকে না জানানোর কারণে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা বাড়ছে।
ক্যাম্পগুলো এখন মাদকের হটস্পট
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক দফতরের (ইউএনওডিসি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে যত মাদক ঢুকছে তার ১০ শতাংশ ধরা পড়ে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতি বছর পাচার হয় প্রায় পাঁচ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আর মাদক কেনাবেচা করে অর্থপাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত এবং রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাদের অর্থের বড় জোগান পাচ্ছে ইয়াবা ব্যবসা থেকে। জান্তা সরকারের কাছ থেকে রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সেখানকার ইয়াবা তৈরির কারখানা আরাকান আর্মির দখলে চলে যায়। রোহিঙ্গাদের অনেককে ব্যবহার করে ইয়াবা ব্যবসা চালাচ্ছে তারা। কক্সবাজার দীর্ঘদিন ইয়াবার প্রধান রুট হিসেবে পরিচিত। জেলার ১৯টি সীমান্ত পয়েন্ট রয়েছে। মিয়ানমার থেকে প্রায় প্রতিদিন ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথসহ (আইস) নানা প্রচলিত-অপ্রচলিত মাদক ঢুকছে। মিয়ানমার থেকে আসা ১৪ লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের ক্যাম্পগুলো এখন ‘মাদকের হটস্পট’ হয়ে উঠেছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন
জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘ক্যাম্পের অপরাধ কমাতে আমরা যৌথভাবে কাজ করছি। বিশেষ করে মাদক নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। রোহিঙ্গাকেন্দ্রিক যেকোনো অপরাধ দমনে সবসময় তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।’
ভয়েস/আআ