বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২২ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

অন্ধকার যুগে নবুয়তের আলো

মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ:
ইসলামপূর্ব অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগকে বলা হয় জাহেলি যুগ। সেই যুগে কোনো ন্যায়নীতি, মানবতা ও ভ্রাতৃত্ব ছিল না। হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, নারীর অবমাননা, গোত্রীয় অহমিকা ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অপরাধ-অপকর্ম চলত প্রকাশ্যে, যেন সেটাই সমাজের নিয়ম ও সংস্কৃতি। এই আঁধার ঘেরা প্রান্তরে আলোকবর্তিকার মতো আবির্ভূত হন নবী মুহাম্মদ (সা.)।

তিনি জাহেলিয়াতের অমানিশাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন, গ্রহণ করলেন সমাজ সংস্কারের কঠিনতম দায়িত্ব। তিনি যে স্বপ্ন বুকে ধারণ করেছিলেন, তা শুধু একটি জাতির নয়, বরং গোটা মানবতার মুক্তির এক মহৎ আহ্বান। তিনি মানুষের মঙ্গে শুরু করলেন দাওয়াতি কাজ। অশান্তির স্থলে শান্তি, অন্যায়ের স্থলে ন্যায়, অন্ধকারের স্থলে আলো প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করলেন।

দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তার অক্লান্ত শ্রম, ধৈর্য ও দাওয়াতের ফলে ধীরে ধীরে রূপ নিল নতুন বাস্তবতায়। যে সমাজ একদিন নিমজ্জিত ছিল পশ্চাৎপদতায়, ধীরে ধীরে সেটি রূপান্তরিত হতে লাগল সভ্যতার আদর্শ কেন্দ্রে। অবশেষে তিনি সফল হলেন চূড়ান্ত সাফল্যে। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগকে তিনি বদলে দিলেন সোনালি আলোয়। জাহেলিয়াতের আঁধার থেকে উঠে এলো নুরের আলো। অমানিশা ভেদ করে জায়গা করে নিল নবুয়তের সূর্য। সেই সূর্যালোক আজও মানবজাতির জন্য অক্ষয় দিশারী, যা যুগে যুগে আলোকিত করে চলেছে দুনিয়াকে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণী উল্লেখ করা হলো।

জাহেলি যুগ : জাহেলি যুগ হলো সেই সময়কাল, যা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়তের পূর্বে আরব উপদ্বীপে বিরাজমান ছিল। এ যুগ প্রায় ২০০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে চলমান ছিল। এ সময়কে জাহেলি যুগ বলা হয়, যা মূলত অজ্ঞতার কারণে।

জাহেলি যুগের চিত্র : জাহেলি যুগের বাস্তব চিত্রটা নিখুঁতভাবে এঁকেছেন হজরত জাফর তায়্যার (রা.) বাদশাহ নাজ্জাশির দরবারে। তিনি সেদিন দীপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে বাদশাহ! আমরা ছিলাম অজ্ঞ, মূর্খ ও বিভ্রান্ত জাতি। আমাদের ধর্ম ছিল কেবল হাতে গড়া মূর্তির পূজা করা। আমাদের রীতি ছিল মৃত জন্তুর গোশত খাওয়া। আমাদের সমাজ ছিল ব্যভিচারে ভরপুর। অন্যায় ও নৃশংসতায় আমরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলাম। আমরা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতাম। প্রতিবেশীর হকের কোনো পরোয়া করতাম না। আমাদের শক্তিমানরা দুর্বলকে গিলে খেত। অত্যাচার করতে পারাকে আমরা গর্বের বিষয় মানতাম। এভাবেই আমরা ডুবে ছিলাম অমানবিকতা ও অন্ধকারের আঁধারে। আমাদের এ দুর্দশা বিরামহীনভাবে যুগের পর যুগ চলতে থাকে। এমন অবস্থায় মহান আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করলেন। তিনি আমাদের মধ্যে পাঠালেন একজন নবী, যাকে আমরা জন্ম থেকেই জানি। তার বংশ পরিচ্ছন্ন। চরিত্র মহান। সততা ও সত্যবাদিতায় তিনি অতুলনীয়। আমাদের চোখের সামনেই তার শুদ্ধ নৈতিকতা ও নির্মল জীবন প্রতীয়মান। তিনি এলেন হেদায়াতের আলো নিয়ে। হাতে ধরে দেখালেন সত্যের প্রদীপ। তার আগমনেই মুছে গেল জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশা। ছিন্ন হলো অন্যায়ের শৃঙ্খল। উন্মোচিত হলো আলোর দিগন্ত। (সিরাতে ইবনে হিশাম ১/৩২১)

জাহেলি যুগের মন্দ বৈশিষ্ট্যসমূহ : জাহেলি যুগের সবচেয়ে বড় মন্দদোষ ছিল মূর্তিপূজা। কাবা শরিফকে ঘিরে তিন শতাধিক মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। প্রতিটি গোত্রের আলাদা দেবতা ছিল এবং তারা সেই দেবতার পূজা করত। এমনকি কাবার ভেতরও মূর্তি রাখা হয়েছিল। হজও হয়ে গিয়েছিল মূর্তিপূজা কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান। আল্লাহর একত্ববাদ ও হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর রেখে যাওয়া তাওহিদের শিক্ষা ভুলে গিয়ে তারা অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল।

কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস : সেসব লোকদের দৈনন্দিন জীবনে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভাগ্য গণনা, জ্যোতিষবিদ্যা, পাখির ডাক, পশুর চলাফেরা, হাড়-হাড্ডির ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা, এসব ছিল তাদের সাধারণ প্রথা। যুক্তিবোধ, জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার বদলে তারা এসব কুসংস্কারকে পথপ্রদর্শক মনে করত। ফলে সমাজে যৌক্তিক চিন্তা ও বাস্তব বিচার প্রক্রিয়ার কোনো স্থান ছিল না।

নারীর অবমাননা : জাহেলি সমাজে নারীর অবস্থান ছিল অত্যন্ত করুণ। তাদের সম্পত্তির মতো গণ্য করা হতো। উত্তরাধিকার থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। বিধবা নারীদের জোরপূর্বক কব্জা করা হতো। কন্যাশিশুর জন্মকে লজ্জাজনক মনে করা হতো। তাই অনেকেই জীবন্ত কন্যাশিশুকে মাটিতে পুঁতে ফেলত। এভাবে ওই যুগে নারীরা ছিল নির্যাতন, অবমাননা ও অমানবিকতার শিকার।

সামাজিক অসংগতি : ব্যভিচার, মদপান, জুয়া, সুদ, খুন-খারাবি ও লুণ্ঠন ছিল তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারও জীবন বা সম্পদের নিরাপত্তা ছিল না। যার শক্তি বেশি, তার প্রভাব ও ক্ষমতাই আইন হিসেবে বিবেচিত হতো। দুর্বলরা সবসময় শোষিত হতো। নৈতিকতার কোনো মানদণ্ডই সমাজে কার্যকর ছিল না।

ন্যায়বিচারের অভাব : কোনো রাষ্ট্রীয় বা একক আইন ছিল না। গোত্রপ্রধানের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ন্যায়বিচারের পরিবর্তে শক্তিশালীর শাসন চলত। দুর্বল শ্রেণি সবসময় বঞ্চিত হতো এবং তাদের অধিকার কেউ রক্ষা করত না। ফলে সমাজে শোষণ ও অন্যায় চরম আকার ধারণ করেছিল।

অর্থনৈতিক বৈষম্য : ধনী ও গরিবের মধ্যে ছিল তীব্র বৈষম্য। সুদ ছিল অর্থনীতির প্রধান মাধ্যম। যা গরিবকে নিঃশেষ করে দিত। ধনীরা ক্রমশ ধনী হয়ে উঠত। আর গরিবরা আরও নিপীড়িত হতো। বাণিজ্য, চাষাবাদ ও শ্রমের সুফল সমাজের এক শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল।

প্রতিহিংসাপরায়ণতা : সামান্য ঘটনা থেকেও বড় বড় যুদ্ধ লেগে যেত। গোত্রীয় রেষারেষি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলত। প্রতিহিংসার কারণে হাজার হাজার প্রাণহানি হতো। এসব দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ইতিহাসে ‘আইয়ামুল আরব’ নামে পরিচিত।

জোর যার মুলুক তার নীতি : জাহেলি যুগের সমাজে বিরাজ করত জোর যার মুলুক তার নীতি। ক্ষমতা যার হাতের মুঠোয়, নীতি ও আইনও তার ইচ্ছার দিকে বাঁক নিত। মানুষের রক্তের মূল্য ছিল পানির চেয়ে সস্তা। প্রতিদিন হানাহানি, মারামারি ও রক্তপাত ছিল নিত্যনৈমিত্তিক শোকাবহ দৃশ্য। কেউ জানত না, কেন তাকে হত্যা করা হচ্ছে।

আলোকবর্তিকার আগমন : এই অন্ধকারে এসে দীপ্তি হয়ে প্রকাশিত হন নবী মুহাম্মদ (সা.)। তিনি পৃথিবীর আলোকবর্তিকা রূপে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। তিনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনেন। তার জীবন ও চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সমাজে ন্যায়, মানবিকতা ও সদাচারের বীজ বপন করেন।

রাসুল (সা.)-এর শিক্ষা প্রতিটি অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হয়ে উঠেছিল। বহু ঈশ্বরের বদলে তিনি গড়ে তুলেন আল্লাহর একত্ববাদের দালান। নারীদের দেন প্রাপ্ত মর্যাদা। কন্যাশিশুর অধিকার নিশ্চিত করেন। সামাজিক অসংগতি, সুদ ও লুণ্ঠন বিলুপ্ত করে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিহিংসা, রক্তক্ষয় ও জুলুমের সংস্কৃতিকে নিন্দা জানিয়ে মানবতার প্রতি দয়া, ক্ষমা ও ন্যায়ের পথ প্রদর্শন করেন।

রাসুল (সা.)-এর প্রতিরোধ কেবল তাত্ত্বিক ছিল না, বরং তিনি জীবনের প্রতিটি ধাপে তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। তিনি নিজেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন সত্য, ধৈর্য ও ন্যায়ের পথে চললে অন্ধকার দূর হয় এবং সমাজকে আলোর দিকে নেওয়া যায়। জাহেলি যুগের সব অমানবিক প্রথা, কুসংস্কার ও শোষণ তিনি একে একে দূর করে মানুষের হৃদয়ে ইমানের আলো জ্বালিয়েছিলেন। ফলে জাহেলি যুগের অন্ধকার যতই ঘন হোক, রাসুল (সা.)-এর আলোর দীপ্তি তা ছাপিয়ে গিয়েছে। তার শিক্ষা-দীক্ষা আজও মানুষের জীবনকে আলোকিত করে চলছে। তার জ্ঞানের আলোতে দূর হয়েছে সহস্রকালব্যাপী জমে থাকা আঁধার।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION