বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৫ পূর্বাহ্ন
মো. আবদুর রহমান:
মানুষের জীবনে ভয় একটি স্বাভাবিক অনুভূতি। তবে আল্লাহর ভয়, যা প্রকৃত অর্থে তাকওয়া হিসেবে পরিচিত, তা এক পবিত্র অনুভূতি। এ ভয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আল্লাহর মহত্ত্ব, মর্যাদা ও ভালোবাসার প্রতি গভীর উপলব্ধি। আল্লাহকে ভয় করা মানেই তার নির্দেশ মেনে চলা, হারাম থেকে বিরত থাকা এবং জীবনকে তার সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করা।
আল্লাহর ভয়ের অন্যতম প্রকাশ হলো অশ্রু। দুনিয়ার নানা দুঃখ-কষ্টে মানুষ কাঁদে, কিন্তু আল্লাহর ভয়ে ঝরানো চোখের পানি সর্বাধিক মূল্যবান। এ অশ্রুর বিনিময়ে আল্লাহ কেয়ামতের দিন আরশের ছায়া দান করবেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন এবং বান্দাকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) অসংখ্য হাদিসে এ কান্নার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। সাহাবায়ে কেরামও আল্লাহর ভয়ে কান্না করতেন, এটা আমাদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
যে বান্দা আল্লাহকে ভয় করে, সে গুনাহ থেকে দূরে থাকে, অন্যায়ের পথে হাঁটে না, আল্লাহর সীমারেখা লঙ্ঘন করে না। এমন বান্দাকে কোরআনে মুত্তাকি বলা হয়েছে। আল্লাহর ভয় মানুষকে শুধু গুনাহ থেকে রক্ষা করে না, বরং তাকে আল্লাহর প্রতি আরও বেশি অনুগত ও নিবেদিতপ্রাণ বানায়। মানুষ যত বেশি আল্লাহকে চিনবে, তত বেশি তার অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা জন্ম নেবে।
দুনিয়াতে আল্লাহকে ভয় করা উভয় জগতে সফলতার মাধ্যম। মহান আল্লাহ যেমন ক্ষমাশীল, তেমনি কঠোর শাস্তিদাতা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যেমন ভয় করা উচিত। আর মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ (সুরা আলে ইমরান ১০২) এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, আল্লাহকে যথার্থরূপে ভয় করতে হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় করে আল্লাহ তার সকল বিষয় সমাধান করে দেন।
আল্লাহর ভয়ে নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দূরে থাকা বা যে কাজ করার কারণে মানুষকে আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়, তা থেকে নিজেকে রক্ষা করা হচ্ছে আল্লাহভীতি। আর যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় রয়েছে এবং যারা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকেন তাদের বলা হয় মুত্তাকি। মূলত যার অন্তর যত পরিষ্কার এবং যার অন্তরে আল্লাহর ব্যাপারে যত বেশি ভালোবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে, আল্লাহর ব্যাপারে জ্ঞান আছে, সে আল্লাহকে তত বেশি ভয় করে। এ জন্য আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই তাকে ভয় করে।’ (সুরা ফাতির ২৮) আর স্বীয় রব সম্পর্কে বান্দার জ্ঞান যত বাড়বে, তার প্রতি তত বেশি ভয় তৈরি হবে। ফলে সে এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন সে তাকে দেখছে।
আল্লাহর ভয়ে কান্নার গুরুত্ব অত্যধিক। কান্না স্বতন্ত্র কোনো কাজ নয়। কান্না হলো হৃদয়ের অভিব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। নবী ও রাসুলদের পর সাহাবিরা ছিলেন মানব জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। আল্লাহতায়ালার প্রতি তাদের ভলোবাসা, ভয় এবং ইসলামের জন্য তাদের অসাধারণ ত্যাগ আমাদের বিস্মিত করে। আল্লাহর ভয়ে তারাও ক্রন্দন করতেন। তাবেয়ি সাবিত আল বুনানি (রহ.)-এর চোখের জ্যোতি ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারের কাছে পরামর্শ চাওয়া হলো। ডাক্তার অধিক কান্নার কারণ জানতে পেরে পরামর্শ দিলেন কান্না বন্ধ করতে হবে, তাহলেই চোখ ঠিক হয়ে যাবে। উত্তরে তিনি বললেন, এমন চোখ দিয়ে আমার কী লাভ, যে চোখে কান্না নেই? এমনই ছিল তাদের কান্না।
আল্লাহতায়ালার ভয়ে দুই ফোটা চোখের পানি ফেলতে পারা গোটা পৃথিবীর প্রশান্তি, পরিতৃপ্তি ও মুগ্ধতার চেয়ে অনেক বেশি উত্তম। যার মূল্য হচ্ছে কেয়ামতের ভয়াবহ দিনে আল্লাহর আরশের নিচে ছায়া লাভ এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি। চোখের পানির কত মূল্য, সুবহানাল্লাহ! এই চোখের পানি আল্লাহর কাছে অনেক প্রিয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না, দুধ দোহন করার পর তা যেমন আর গাভীর ওলানে ফিরিয়ে নেওয়া অসম্ভব। আল্লাহর পথে জিহাদের ধুলাবালি এবং জাহান্নামের আগুন কখনো একত্রিত হবে না।’ (তিরমিজি)
রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘কেয়ামত দিবসে সাত শ্রেণির লোককে আল্লাহ তার আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। তাদের অন্যতম ওই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে (জিকির করে), ফলে তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয়।’ (সহিহ বুখারি) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুই প্রকার চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। যে চোখকে আল্লাহর ভয়ে কাঁদে এবং যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় পাহারাদারিতে নির্ঘুম রাত অতিবাহিত করে।’ (তিরমিজি)
অশ্রু হৃদয়ের প্রশান্তি। অশ্রুতে আছে মুক্তি, হোক তা মাছির মাথা পরিমাণ। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর (আজাবের) ভয়ে যে মুমিন বান্দার দুচোখ থেকে অশ্রু বের হয়, যদিও তা মাছির মাথা পরিমাণ হয়, এরপর তার চেহারায় কিছু গড়িয়ে পড়ে, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)
ভয় ও কান্না একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বস্তত যখন কারও অন্তরে ভয় ঢোকে, তখন আপনা আপনিই কান্না আসে। অশ্রুই বলে দেয় তার অন্তরে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। আল্লাহর নেক বান্দাদের মধ্যে এটি বিদ্যমান থাকে। পক্ষান্তরে পাপী বান্দার অন্তরে তা পরিলক্ষিত হয় না। আল্লাহর ভয়ে কান্না ও ভীত থাকা প্রকৃত ইমানদারের একটি মহৎ গুণ ও বৈশিষ্ট্য।
জাহান্নামের অধিবাসীরা জ্বলন্ত আগুনে পড়ে চোখের পানি বের করে কাঁদতে থাকবে। চোখের পানিও একদিন শেষ হয়ে যাবে। তারপর তারা রক্ত দিয়ে কাঁদতে থাকবে। তখন তাদের ওই কান্না কোনো উপকারে আসবে না। যদি তারা দুনিয়াতে আল্লাহর ভয়ে কান্নাকাটি করত, তাহলে পরকালে সে লাভবান হতো এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেত।
ভয়েস/আআ