বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২২ পূর্বাহ্ন
মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ:
মানুষ স্বভাবতই ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। কাল কী হবে, সংসার কীভাবে চলবে, সন্তানের খরচ কোথা থেকে আসবে, এসব চিন্তা প্রায় প্রতিটি মানুষের মনে ঘুরপাক খায়। তবে ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, রিজিক নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা কাম্য নয়। কারণ রিজিক মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে রখেছেন। সুতরাং মানুষের জীবিকা নির্ধারিত। যতক্ষণ তার জীবন আছে, ততক্ষণ তার রিজিকও অব্যাহত থাকবে। তাই রিজিক নিয়ে ভয়, আতঙ্ক বা হতাশায় ভোগা ইমানদারের কাজ নয়। তবে আমাদের তা পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করতে হবে। আমাদের উচিত আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা, হালাল উপার্জনের চেষ্টা করা এবং অবৈধ পথ থেকে দূরে থাকা।
রিজিক আল্লাহর পক্ষ থেকে সেসব অনুগ্রহ ও উপকরণ যা মানুষের জীবনকে উপকৃত করে। এটি শুধু টাকা-পয়সার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং রিজিকের মধ্যে রয়েছে শস্যের শাক-সবজি, ফল, ব্যবসা-বাণিজ্য, এমনকি সুস্থ দেহ-মন, উত্তম স্ত্রী, নেক সন্তান, ভালো বন্ধু ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ। বলা হয়ে থাকে, রিজিকের সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ। আর সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা। এমনিভাবে রিজিকের সর্বোত্তম স্তর হচ্ছে পুণ্যবান স্ত্রী ও পরিশুদ্ধ নেক সন্তান। আর রিজকের পরিপূর্ণ স্তর হচ্ছে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। আল্লাহতায়ালা প্রতিটি প্রাণীর জন্য রিজিকের সীমা নির্দিষ্ট করেছেন। কোনো প্রাণীই মৃত্যুবরণ করবে না যতক্ষণ না তার ভাগ্যে নির্ধারিত রিজিক সে গ্রহণ করে।
নির্ধারিত রিজিক আসবেই : এক হাদিসে রাসুল (সা.) হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-কে বলেন, হে আব্বাস তনয়! জেনে রেখো, সমগ্র বিশ্ব যদি একত্র হয়ে তোমাকে কিছু দিতে চায়, তাহলে তারা কেবল সেইটুকুই দিতে পারবে, যা আল্লাহ তোমার জন্য নির্ধারণ করেছেন (এরচেয়ে বেশি কিছু তোমাকে তারা দিতে পারবে না)। এমনিভাবে সমগ্র বিশ্ব যদি একত্র হয়ে তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায় (তোমার কোনো নির্ধারিত রিজিক ছিনিয়ে নিতে চায়), তারা কেবল সেইটুকুই পারবে, যা আল্লাহ তোমার ভাগ্যে লিখে রেখেছেন (এর বেশি কিছু তারা পারবে না)।’ (সুনানে তিরমিজি ২৫১৬) সুতরাং বান্দার কর্তব্য শুধু হালাল পথে চেষ্টা করা, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা এবং সন্তুষ্টচিত্তে তার লিখে দেওয়া তাকদির মেনে নেওয়া।
রিজিকের প্রকারভেদ : অনেক মানুষ মনে করে, রিজিক শুধু অর্থ-সম্পদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটা রিজিক সম্পর্কে একটি সংকীর্ণ ধরণা মাত্র। রিজিকের ধরন এত বৈচিত্র্যময় যে, তা কেবল অর্থের ভেতরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের জীবনের প্রায় সব দিককেই তা অন্তর্ভুক্ত করে। মানুষের যা কিছু তার জন্য কল্যাণকর ও উপকারী, এই সবকিছুই রিজিকের অন্তর্ভুক্ত।
ইমানের রিজিক : যে ব্যক্তি তার রবের প্রতি ইমান আনে, বিশ্বাস রাখে, সে প্রকৃত অর্থে মহান রিজিকের অধিকারী। কেননা রিজিকের মূল বৈশিষ্ট্য হলো, এটি মানুষের উপকারে আসে এবং কল্যাণ বয়ে আনে। আর ইমান এমন এক রিজিক, যা মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করায় এবং দুনিয়া ও আখেরাতে পরম সুখ দান করে।
জ্ঞান ও প্রজ্ঞার রিজিক : জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে এক মহান দান। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে, তাকে বাস্তবিক অর্থেই বিপুল কল্যাণ দান করা হয়েছে। একইভাবে দ্বীনের গভীর উপলব্ধি ও ফিকহ এক বিশাল রিজিক। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যার জন্য কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের ফিকহ (বিশুদ্ধ গভীর বুঝ) দান করেন।’
স্বাস্থ্য ও সুস্থতার রিজিক : স্বাস্থ্য এমন এক মহামূল্যবান রিজিক, যা অনেক মানুষের কপালে জুটে না। যার শরীর সুস্থ, সে যেন পুরো দুনিয়ার মালিক। ইমানের পর দুনিয়ায় এমন আর কোনো নেয়ামত নেই, যা সুস্থতা ও নিরাপদ দেহের সমকক্ষ হতে পারে।
ধন-সম্পদের রিজিক : এটিই মানুষের কাছে সবচেয়ে পরিচিত রিজিক। মানুষ এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে, প্রয়োজন মেটায় এবং নিজে ও পরিবার-পরিজনকে নিয়ে উপকৃত হয়।
পুণ্যবতী স্ত্রীর রিজিক : একজন নেককার স্ত্রী আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত এক বিশেষ রিজিক। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুনিয়াতে উপকার অর্জনের অনেক সামগ্রী রয়েছে। তবে সেগুলোর মধ্য থেকে পুণ্যবতী স্ত্রীর তুলনায় উত্তম আর কিছু নেই। (সহিহ মুসলিম ৩৫৩৫)
নেককার সন্তানের রিজিক : সৎ ও ধার্মিক সন্তান দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রিজিক। কারণ বদকার সন্তান বাবা-মা ও সমাজ উভয়ের জন্য কষ্ট ও দুর্দশার কারণ হয়। পক্ষান্তরে সৎ ও নেককার সন্তান বাবা-মায়ের চোখের শীতলতা, দুনিয়া ও আখেরাতের সুখের উৎস হয়ে ওঠে।
মানুষের ভালোবাসা লাভের রিজিক : মানুষের ভালোবাসার পাত্র হওয়া, এটিও আল্লাহর এক মহান রিজিক। যে ব্যক্তি অন্যদের মন ও হৃদয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে, যার প্রতি মানুষ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, সে প্রকৃতপক্ষেই ভাগ্যবান। মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারা সহজ কথা নয়, এটি কেবল আল্লাহর প্রদত্ত সৌভাগ্য ও অনুগ্রহের ফল। তবে এই ভালোবাসা ও মর্যাদার উৎস হতে হবে শরিয়ত সম্মত। যদি তা নৈতিক ও ধর্মীয় সীমানার বাইরে হয়, তাহলে তা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।
রিজিক নির্ধারিত, অন্বেষণ অপরিহার্য : রিজিক আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, এটি একটি অনুপম সত্য। যা আমাদের বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমরা শুধুই বসে বসে অপেক্ষা করব। বরং উক্ত নির্ধারিত রিজিক অর্জন করার জন্য অন্বেষণ অপরিহার্য। মানুষ এই বিষয়ে সাধারণত দুই ধরনের ভুল ধারণায় বিভ্রান্ত হয়। তা উল্লেখ করা হলো। যেহেতু আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে প্রতিটি বান্দার রিজিক নির্ধারিত, তাই আমাদের উচিত আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী রিজিক অনুসন্ধান করা।
ভয়েস/আআ