বুধবার, ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:২৮ পূর্বাহ্ন
মুফতি উবায়দুল হক খান:
মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ সমাজ। সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন নৈতিকতা, আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য। বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে দুর্নীতি, মাদকাসক্তি, ব্যভিচার, পরনিন্দা, পারিবারিক অশান্তি ও মূল্যবোধের যে অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে, তা থেকে মুক্তির জন্য ইসলামের শিক্ষার বিকল্প নেই। কোরআন ও হাদিস আমাদেরকে সমাজ গঠন ও অবক্ষয় প্রতিরোধে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। এই বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণী উল্লেখ করা হলো।
সামাজিক অবক্ষয়ের বাস্তবতা : বর্তমানে আমাদের সমাজে যে চিত্র চোখে পড়ে, তা খুবই উদ্বেগজনক। মানুষ স্বার্থপর, ভোগবাদী ও দায়িত্বহীন হয়ে পড়ছে। পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়েছে, নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ মিথ্যা বলাকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করছে, সুদ-ঘুষকে ব্যবসা মনে করছে, আর অশ্লীলতাকে সংস্কৃতি বলে প্রচার করছে। এই সামাজিক অবক্ষয় আমাদের পারিবারিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
সমাজ ও নৈতিকতার গুরুত্ব : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এটি শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত নয়, বরং সমাজ গঠনের প্রতিও অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে। ইসলামে আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য যে মূল্যবোধ ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা পালন করলেই সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধ করা সম্ভব। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমরা উত্তম জাতি, যাদেরকে মানুষের (কল্যাণের) জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজে নিষেধ করো। আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো।’ (সুরা আলে ইমরান ১১০) এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়, মুসলমানদের দায়িত্ব হলো সমাজে ন্যায়ের আদেশ এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। সামাজিক অবক্ষয় রোধে কোরআনের দিকনির্দেশনা উল্লেখ করা হলো।
সততা ও আমানতদারিতা : মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেন আমানত তার প্রাপকের কাছে পৌঁছে দিতে এবং মানুষের মধ্যে বিচার করলে ন্যায়ের সঙ্গে বিচার করতে।’ (সুরা নিসা ৫৮) যেখানে আমানত রক্ষা করা হয় না, সেখানে সমাজ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। তাই সততা একটি মূল সামাজিক ভিত্তি।
অশ্লীলতা থেকে বাঁচা : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ব্যভিচারের ধারে-কাছেও যেও না। এটি একটি অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট পথ।’ (সুরা ইসরা ৩২) ব্যভিচার সামাজিক অবক্ষয়ের মূল উৎসগুলোর একটি। এতে পরিবার ধ্বংস হয়, সম্পর্ক ভেঙে যায়, সন্তানরা পথভ্রষ্ট হয়।
পরনিন্দা, গিবত ও অপবাদ নিষিদ্ধ : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের কেউ যেন অপর কারো উপহাস না করে…। তোমরা একে অপরের গিবত করো না…।’ (সুরা হুজুরাত ১১-১২)
সৎকাজে আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা পরস্পরকে সৎকাজের নির্দেশ দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে…।’ (সুরা তওবা ৭১) সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সমাজে সুবিচার ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে। সামাজিক অবক্ষয় রোধে হাদিসের দিকনির্দেশনা উল্লেখ করা হলো।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা : রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ অধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (সহিহ বুখারি ৮৯৩) এই হাদিস সমাজের প্রতিটি স্তরের দায়িত্বশীলদের কর্তব্য ও জবাবদিহিতা তুলে ধরে।
মুসলিমদের মাঝে ভালোবাসা বৃদ্ধি : হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত পরস্পরকে ভালো না বাসবে।’ (সহিহ মুসলিম) ভালোবাসা, সহানুভূতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা সমাজকে একত্র করে, ভাঙন ঠেকায়।
অন্যায় দেখলে প্রতিরোধ করা : হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো অন্যায় কাজ দেখে, তাহলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি না পারে, তাহলে যেন মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করে। তাও যদি না পারে, তাহলে যেন অন্তরে ঘৃণা করে। আর এটাই ইমানের দুর্বলতম স্তর।’ (সহিহ মুসলিম ৪৯) এখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
বিচারকের ন্যায়নীতি : রাসুল (সা.) বলেন, ‘ন্যায়পরায়ণ শাসক কেয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ার নিচে স্থান পাবে।’ (সহিহ বুখারি) নেতৃত্ব যখন সৎ হয়, তখন সমাজে শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
সমাধানের উপায় : ইসলাম কেবল অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই থেমে থাকে না, বরং প্রতিকারের পথও দেখায়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় উল্লেখ করা হলো।
শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি : শিশুদের ছোটবেলা থেকেই ইসলামি নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে।
ধর্মীয় অনুশীলন : পরিবারই সমাজের ভিত্তি। পরিবারে যদি ধর্মীয় অনুশাসন চর্চা হয়, তাহলে শিশু ও তরুণরা পথভ্রষ্ট হবে না।
গণমাধ্যমের ভূমিকা : সত্য, নৈতিকতা ও ধর্মীয় চেতনা প্রচারে মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকা জরুরি।
দাঈ ও আলেম সমাজের দায়িত্ব : তাদের উচিত সমাজে চলমান নৈতিক অবক্ষয় ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
সভ্যতার পুনর্জাগরণের উপায় : ইসলামের দিকনির্দেশনার আলোকে একটি সুন্দর সমাজ গঠন সম্ভব, যদি ব্যক্তি ও জাতি সেই নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করে। কোরআন ও হাদিস শুধুই ইবাদত নয়, বরং পরিপূর্ণ সমাজ গঠনের রূপরেখা দেয়। সামাজিক অবক্ষয় রোধে ইসলামের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নই হতে পারে জাতি ও সভ্যতার পুনর্জাগরণের একমাত্র উপায়।
ভয়েস/আআ