সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৫৫ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

দুনিয়া মুমিনের কারাগার

মো. আবদুর রহমান:
মুমিন আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বিশ্বাসী। যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর একত্ববাদ এবং রাসুল (সা.)-এর রিসালাত, সব নবী-রাসুল, ফেরেশতা, আসমানি কিতাব, পরকাল ও তকদিরের ওপর পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে বিশ্বাস করে এবং মহান আল্লাহর প্রতিটি হুকুম-আহকাম মেনে চলে, তাকেই মুমিন বলা হয়। মহান আল্লাহ দুনিয়াতে চলার জন্য মানুষকে কিছু বিধিনিষেধ দিয়েছেন। সেসব বিধিনিষেধের মধ্যে এমন কিছু বিধান আছে, যা মুমিনকে কাফেরদের থেকে আলাদা করে। সেগুলো পালনের জন্য মুমিনকে কষ্ট করতে হয়, যে কষ্ট কাফেরদের করতে হয় না। যিনি মুমিন, তিনি সেসব বিধান মানতে বাধ্য। কয়েদিরা কারাগারে যেমন সেখানকার নিয়ম মানতে বাধ্য থাকে, মুমিনরাও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে কিছু নিয়ম মানতে বাধ্য। তাই দুনিয়াকে মুমিনের কারাগার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দুনিয়ার জীবন মূল্যহীন ও ক্ষণস্থায়ী। মুমিন যেন দুনিয়ার জীবনকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে নিজের আখেরাত নষ্ট না করে। দুনিয়ার এই স্বল্পকালীন জীবনের সুখের জন্য চিরস্থায়ী জীবনের ক্ষতি করা বোকামি। দুনিয়ার সম্পদ, সম্পর্ক, পরিবার-পরিজন ও সন্তানদের মোহ যেন আল্লাহর স্মরণ ও ইবাদত থেকে গাফেল না করে দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানসন্ততি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। যারা এ রকম করবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সুরা মুনাফিকুন ৯)

আবু হুরায়য়া (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া হলো মুমিনের জন্য কারাগার। আর কাফেরের জন্য জান্নাত।’ (সহিহ মুসলিম ২৯৫৬)

দুনিয়া মুমিনের জন্য কারাগার, এ কথার অর্থ হলো, একজন মুমিন চাইলেই দুনিয়াতে যা ইচ্ছে করতে পারে না। তাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে হয়। একজন বন্দি যেভাবে কারাগারকে নিজের ঘর মনে করে না, বরং সর্বদা নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে। তেমনই মুমিনরা কখনো পৃথিবীকে নিজেদের আবাসস্থল মনে করে না, বরং পরকালের চিন্তায় সর্বদা সে মগ্ন থাকে।

একইভাবে মুমিন কখনো অভাব-অনটনে বিচলিত হয় না। কেননা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, মৃত্যুর পর তার গন্তব্য হবে চিরস্থায়ী জান্নাত। যেখানে কোনো অভাব থাকবে না। বরং সেখানে থাকবে চিরস্থায়ী সুখ ও আনন্দ।

পক্ষান্তরে একজন অমুসলিম মহান আল্লাহর বিধিনিষেধের কোনো তোয়াক্কা করে না। সে মহান আল্লাহ থেকে বন্ধনমুক্ত হয়ে চতুষ্পদ জন্তুর মতো লাগামহীন জীবনযাপন করে। ফলে সে যা খুশি তাই করতে পারে। জীবন চলার পথে তাকে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয় না।

যদিও পৃথিবী কখনো জান্নাতের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না, তবুও পৃথিবীকে কাফেরের জান্নাত বলার অর্থ হচ্ছে, তারা দুনিয়াকে জান্নাত ভেবে দুনিয়ার জীবনকে উপভোগ করার সম্ভাব্য সব পন্থা অবলম্বন করে থাকে।

প্রকৃত অর্থে দুনিয়া নিন্দিত বস্তু নয়। বরং প্রশংসা ও নিন্দা উভয়ই দুনিয়ায় বান্দার কাজের প্রতি প্রযোজ্য। দুনিয়া হলো আখেরাতের সেতু। দুনিয়া থেকেই জান্নাতের পাথেয় সংগ্রহ করতে হয়। জান্নাতবাসীরা যে উত্তম জীবন লাভ করবে, তা মূলত দুনিয়ায় তাদের পুণ্যকর্ম ও উত্তম বীজ বপন কাজের বিনিময়েই অর্জিত হবে। অতএব দুনিয়া হলো নামাজ, রোজা এবং দান-সদকা এবং কল্যাণমূলক কাজে প্রতিযোগিতার সঙ্গে ধাবিত হওয়ার স্থান।

সৌভাগ্যবান বান্দা তো তারাই, যারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে পরকালের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করে। পিঁপড়া যেমন শীতকালের দুর্ভোগ থেকে বাঁচার জন্য গ্রীষ্মকালেই খাবার ও পাথেয় সংগ্রহ করে রাখে, মুমিন বান্দাও ঠিক তেমনি পরকালের কঠিন দুর্ভোগ থেকে বাঁচার উদ্দেশে দুনিয়াতে থাকতেই আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের মাধ্যমে নেক আমল সংগ্রহ করে।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘বস্তুত তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী।’ (সুরা আলা ১৬-১৭) তাই দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের মোহে পড়ে পরকালের পাথেয় সংগ্রহ থেকে উদাসীন হওয়া যাবে না।

এ জগৎ প্রকৃত অর্থে পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্র, যেখানে মানুষকে নিজের প্রবৃত্তি, চাওয়া-পাওয়ার আকাক্সক্ষা ও পার্থিব মোহ থেকে নিজেকে সংযত রাখতে হয়। মুমিন জানে, দুনিয়ার প্রতিটি কষ্ট, প্রতিটি ত্যাগ, প্রতিটি বঞ্চনা একদিন জান্নাতের অফুরন্ত শান্তি ও আনন্দে পরিণত হবে। তাই সে আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলতে গিয়ে যে কষ্টের সম্মুখীন হয়, সেটাও তার কাছে আনন্দেরই অংশ হয়ে ওঠে। কেননা সে বিশ্বাস করে, এই দুনিয়ার অস্থায়ী কারাবাসের পর অপেক্ষা করছে আখেরাতের অনন্ত সুখ।

যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান মেনে চলে, সে আসলে নিজেকে কারাগারে নয়, বরং নিরাপত্তার ঘেরাটোপে রাখে। এই সীমাবদ্ধতাই তাকে সত্যিকারের স্বাধীনতা দেয়, পাপ ও অন্যায় থেকে মুক্ত রাখে। দুনিয়ার ভোগবিলাস, প্রতারণা, অন্যায় ও অবাধ স্বাধীনতার মোহে যারা পড়ে, তারা আপাতদৃষ্টিতে স্বাধীন হলেও আত্মিকভাবে বন্দি। মুমিন দুনিয়ার শৃঙ্খলায় বাঁধা থাকলেও অন্তরে মুক্ত, কারণ তার হৃদয়ে আল্লাহর ভয়, ভালোবাসা ও পরকালের প্রত্যাশা জাগ্রত থাকে।

মুমিন দুনিয়ার জীবনে যেমন ধৈর্যধারণ করে, তেমনি সে সর্বদা জানে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অটল। এ জীবনে যত কষ্টই আসুক, যত সীমাবদ্ধতাই থাকুক, সেগুলো একদিন জান্নাতের প্রশস্ত বাগানে অবলুপ্ত হবে। সে কারণেই একজন সত্যিকারের মুমিন দুনিয়াকে চূড়ান্ত গন্তব্য মনে করে না, বরং এটিকে মনে করে একটি যাত্রাপথ, যার পরেই অপেক্ষা করছে তার চিরনিরাপত্তার আবাস।

অতএব দুনিয়া মুমিনের কাছে কখনো নিছক বঞ্চনার স্থান নয়, বরং এটি আত্মগঠন, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহের স্থান।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক

ভয়েস/আআ/সূত্র:দেশরূপান্তর

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION