বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫৬ অপরাহ্ন
আইনাল হক:
মহান আল্লাহর অসংখ্য গুণের মধ্যে অন্যতম হলো দয়া ও অনুগ্রহ। পবিত্র কোরআনে ও হাদিসে আল্লাহর এই গুণের বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। প্রতিটি সৃষ্টির ওপর তার অনুগ্রহ বিরাজমান। আর বিশেষ বান্দার প্রতি তিনি বিশেষ দয়া বর্ষণ করেন, যারা তার নির্দেশ মেনে চলে এবং অন্যের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে। কেননা মানুষের প্রতি দয়া করা ইমানের দাবি। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জীবনাচারে এই দয়া ও মমতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা মুমিনদের জন্য আদর্শ হয়ে আছে।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সব প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য, যিনি পরম করুণাময় দয়ালু।’ (সুরা ফাতিহা ২-৩) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সুরা কাহাফ ৫৮)
রহমান ও রহিম আল্লাহর দুটি গুণবাচক নাম। তবে একটির তুলনায় অপরটিতে দয়ার অর্থ বেশি পাওয়া যায়। রহমান নামটি মহান আল্লাহর জন্য বিশেষায়িত। যা অন্য কারও জন্য ব্যবহার করা বৈধ নয়। কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, আল্লাহর রহমান নামটি ব্যাপকার্থক অর্থাৎ যিনি সমগ্র সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহ করেন। তা এভাবে যে, তিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন। অন্যদিকে আল্লাহর রহিম নামটি কেবল মুমিনদের জন্য বিশেষায়িত। এই হিসেবে যে, তিনি তাদের ইমানের পথ দেখিয়েছেন এবং পরকালে তাদের জন্য অন্তহীন পুরস্কার রেখেছেন।
আল্লামা সাদি বলেন, ‘রহমান ও রহিম আল্লাহর দুটি গুণবাচক নাম, যা আল্লাহর সর্বব্যাপী অনুগ্রহকে বোঝায়। যা সব জীবকে অন্তর্ভুক্ত করে। আল্লাহ তার অনুগ্রহকে প্রধানত নবী-রাসুলদের অনুসারী আল্লাহ ভীরুদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। তবে তারা ছাড়া অন্যদেরও আল্লাহর অনুগ্রহে সামান্য অংশ আছে।’ (তাফসিরে সাদি ৩৯)
আল্লাহর গুণ দয়া ও অনুগ্রহের সঙ্গে মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টির দয়া ও অনুগ্রহের তুলনা নিষিদ্ধ। আল্লাহর দয়াশীলতা তার ভেতর কোনো দুর্বলতা তৈরি করে না, কিন্তু মানুষের দয়াশীলতা কখনো কখনো তার ভেতর দুর্বলতা সৃষ্টি করে। এমনকি তাকে ইনসাফের জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়। তবে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ তার ক্রোধের ওপর প্রবল। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন মহান আল্লাহ মাখলুক সৃষ্টি করলেন, তখন তিনি তার কিতাবে লিপিবদ্ধ করলেন এবং তা তার কাছে আরশের ওপরে আছে। (তিনি লিখেছেন) আমার ক্রোধের ওপর দয়া বিজয়ী থাকবে। (সহিহ মুসলিম)
প্রতিটি সৎকাজের বিনিময়েই মহান আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করেন। মানুষের প্রতি দয়া করাও মহান আল্লাহর এক বড় অনুগ্রহ। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে মানুষের প্রতি দয়া করার বিশেষ ফজিলত ও মর্যাদা ঘোষণা করেছেন।
মানুষের প্রতি দয়া করায় রয়েছে মহান আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়া অপার সম্ভাবনা। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় নবীজি (সা.) এমনই ঘোষণা দিয়েছেন। হাদিসের দিকনির্দেশনাগুলো উল্লেখ করা হলো।
হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ ওই ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করেন না, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না।’ (সহিহ বুখারি) বান্দার জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো মহান আল্লাহর অনুগ্রহ। যে ব্যক্তি আল্লাহর দয়া তথা অনুগ্রহ পাবে, তার দুনিয়া ও পরকাল সফলতায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, একদিন এক বেদুঈন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে এসে দেখল সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের শিশু সন্তানদের চুমু দিয়ে আদর করছেন। তখন সে বলল, তোমরা কি শিশুদের চুম্বন করো? আমরা তো শিশুদের চুম্বন করি না। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যদি মহান আল্লাহ তোমার অন্তর থেকে স্নেহ-মমতা ও দয়া বের করে দেন তবে আমি কি তা বাধা দিতে সক্ষম হব?’ (সহিহ বুখারি)
মহান আল্লাহ ওই ব্যক্তির প্রতি দয়া করেন না, যে মানুষের প্রতি দয়া করে না। মানুষের জন্য এ দিকনির্দেশনা অনুসরণ ও অনুকরণেই রয়েছে দ্রুত আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার অন্যতম উপায়।
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, একদিন এক নারী তার দুটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আমার কাছে আসে। ওই নারী আমার কাছে কিছু চায়। তখন আমার কাছে একটি খেজুর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমি তাকে তা (ওই খেজুর) দিয়ে দিই। সে তা দুই ভাগ করে তার দুই মেয়েকে দেয় আর নিজে খাওয়া থেকে বিরত থাকে। তারপর সে উঠে চলে যায়। এমন সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাড়িতে প্রবেশ করেন। আমি তাকে ঘটনাটি বলি। তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তি মেয়েদের ব্যাপারে সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করে, ওই মেয়েরা তার জন্য জাহান্নামের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।’ (সহিহ বুখারি)
হাদিসটির মূল আলোচ্য বিষয়েও মানুষের প্রতি সহমর্মিতা বা দয়ার কথা ফুটে উঠেছে, তাদের বিপদে পাশে দাঁড়ানো। আর এতে মহান আল্লাহ ওই বান্দার ওপর খুশি হয়ে যান। ফলে ওই ব্যক্তির সার্বিক বিষয়ের ওপর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ বা দয়া নাজিল হতে থাকে।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে যেমন সবার প্রতি দয়াশীল ও কোমল ছিলেন, তেমনি সব মানুষকে পরস্পরের প্রতি সহানভূতিশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যার ফলে তিনি বান্দার প্রতি অনুগ্রহ নাজিল হওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।
হজরত আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘একজন মুমিন অপর মুমিনের জন্য এক ঘরের মতো, যার একাংশ অপরাংশকে সুদৃঢ় রাখে। অতঃপর তিনি এক হাতের আঙুল অন্য হাতের আঙুলের মধ্যে প্রবেশ করান।’ (সহিহ বুখারি)
হজরত নুমান ইবনে বশির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সব মুমিন এক ব্যক্তির (দেহের) মতো, যদি তার চোখ অসুস্থ হয় তখন তার পুরো দেহ অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর যদি তার মাথায় ব্যথা হয় তখন তার পুরো শরীরই ব্যথিত হয়।’ (সহিহ মুসলিম)
তিনি আরও বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তুমি ইমানদারদের তাদের পারস্পরিক সহানুভূতি, বন্ধুত্ব ও দয়া-অনুগ্রহের ক্ষেত্রে একটি দেহের মতো দেখবে। যখন দেহের কোনো অঙ্গ অসুস্থ হয় তখন পুরো শরীর তার জন্য বিনিদ্র ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।’ (সহিহ বুখারি)
হাদিসের অসংখ্য বর্ণনায় বান্দার প্রতি উত্তম ব্যবহার ও দয়া-মায়া দেখানোর দিকনির্দেশনা এসেছে। কেননা বান্দার প্রতি দয়া-অনুগ্রহের মাধ্যমেই আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়া সহজ হয়।
দয়া ও অনুগ্রহ এমন এক গুণ, যা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের পরিচায়ক। মানুষ যখন পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি, করুণা ও অনুগ্রহ দেখায়, তখন তা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ প্রশস্ত করে। সমাজে ন্যায়, শান্তি ও সম্প্রীতির ভিত মজবুত হয় এই দয়ার চর্চার মাধ্যমেই। হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে দয়ার ফজিলত ও অনুগ্রহের প্রতিদান তুলে ধরেছেন, তা মানবজীবনের সব ক্ষেত্রেই দিকনির্দেশনা দেয়। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত নিজের জীবনে এই দয়ার চেতনা জাগ্রত রাখা এবং তা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার দয়া ও অনুগ্রহের ছায়ায় রাখুন, পরস্পরের প্রতি দয়াশীল হওয়ার তওফিক দিন। আমিন।
লেখক : মাদ্রাসাশিক্ষক ও প্রবন্ধকার
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর