সোমবার, ৩০ Jun ২০২৫, ১০:২১ অপরাহ্ন
শাহীন হাসনাত:
সব মানুষই জীবনে ভালো কিছু করতে চায়, সফলতা অর্জন করতে চায়। এ লক্ষ্যে কম-বেশি সবাই নানা ধরনের চেষ্টা-সাধনা করেন। তবে জীবনে সবার লক্ষ্য পূরণ হয় না, সফলদের কাতারে নিজের নাম ওঠানো হয় না। তারপরও সফলতার জন্য মানুষ পথ খুঁজে কী করলে জীবনে সফলতা আসবে? কোন কাজের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য হাসিল হবে? একেকজন একেকভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন, চলেন বিভিন্ন পথে।
নানাভাবে চেষ্টা-তদবিরও করতে থাকেন। কেউ নিজের জীবনের ছোট ছোট সফলতাকে পুঁজি করে মনে সাহস জোগানোর চেষ্টা করেন, আবার কেউ নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকেই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অবলম্বন মনে করেন। অনেকে আবার আশপাশের সফল মানুষকে অনুকরণের চেষ্টা করেন, কেউ বিভিন্ন লেখকের বই পড়ে সফলতার চাবিকাঠি খোঁজেন। অনেকে উদ্দীপ্ত হতে মোটিভেশনাল বক্তার দ্বারস্থ হন।
‘মোটিভেশনাল স্পিচ’ বর্তমান সময়ে খুবই পরিচিত একটি বিষয়। মোটিভেশন তথা অনুপ্রেরণা হলো সেই আকাক্সক্ষা কিংবা শক্তি যা মানুষকে কোনো কিছু অর্জনের জন্য কাজ করার উৎসাহ সৃষ্টি করে। অনুপ্রেরণা এমন একটি বিষয়, যা মানুষকে নির্দিষ্ট কাজের জন্য উৎসাহিত করে অথবা নির্দিষ্ট কিছু করার ইচ্ছা জাগায়। অনুপ্রেরণার ফলে মানুষের মন থেকে হতাশা দূর হয়ে যায়, সে সবকিছু নতুনভাবে ভাবতে শুরু করে।
হাল সময়ে মোটিভেশনাল স্পিকার কিংবা অনুপ্রেরণাদায়ী, অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী বক্তারা বেশ সমাদৃত।
নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বিখ্যাত অনেক বক্তা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য যেমন মানুষের জন্য কল্যাণকর হতে পারে, আবার কিছু নেতিবাচক কারণে তা উল্টো ফলাফলও বয়ে আনতে পারে।
আমরা জানি, পৃথিবীতে যত মানুষ এসেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল হলেন নবী মুহাম্মদ (সা.)। তার জীবনের গাইডবুক হলো পবিত্র কোরআন। আল্লাহ দয়া করে আমাদের কোরআন দান করেছেন, যাতে দিশেহারা জীবনের দিকনির্দেশনা খুঁজে পাই। সুতরাং অনুপ্রেরণা, মনে সাহস আনা এবং নিজের ভেতরের সৃজনশীলতাকে জাগ্রত করার জন্য অন্য কোনো উৎসের দিকে তাকানোর আগে, মোমিন-মুসলমান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কোরআনে কারিম থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা, কোরআন থেকে অনুপ্রেরণা খোঁজা।
এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আপনি কি লক্ষ করেন না আল্লাহ কীভাবে উপমা দিয়ে থাকেন? একটি উত্তম কথার তুলনা উত্তম একটি গাছ, যার মূল সুদৃঢ় এবং যার শাখা-প্রশাখা ওপরে বিস্তৃত। যা সব সময়ে তার ফলদান করে তার রবের অনুমতিক্রমে। আর আল্লাহ মানুষের জন্য উপমাসমূহ পেশ করে থাকেন, যাতে তারা শিক্ষাগ্রহণ করে। আর একটি মন্দ কথার উপমা হলো একটি মন্দ গাছ, যার মূল ভূপৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছিন্নকৃত, যার কোনো স্থায়িত্ব নেই। যারা ইমান এনেছে, আল্লাহ তাদের সুদৃঢ় বাক্য দ্বারা দুনিয়ার জীবনে ও আখেরাতে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন এবং যারা জালেম আল্লাহ তাদের বিভ্রান্তিতে রাখবেন। আর আল্লাহ যা ইচ্ছে তা করেন। ’ -সুরা ইবরাহিম : ২৪-২৭
ইতিহাস সাক্ষী, আল্লাহর রাসুল (সা.) একজন শ্রেষ্ঠ বক্তা ছিলেন। তার হৃদয়স্পর্শী কথা সবাইকে উদ্দীপ্ত করত। নবী করিম ভালো বক্তার প্রশংসা করে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই কোনো কোনো বক্তৃতায় জাদুর প্রভাব থাকে। ’ –সহিহ্ বোখারি
সাম্প্রতিক সময়ে মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে পরিচিত একজনের নেতিবাচক বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে ওই ব্যক্তির সমালোচনা উদ্দেশ্যে নয়, সামগ্রিকভাবে নতুন প্রজন্ম যেন বিভ্রান্ত না হয়; সে ব্যাপারে লেখা প্রয়োজন মনে করছি। এমন বক্তব্য কখনোই কাম্য নয়, যা হিংসা ছড়াবে। কথায় আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, সংকীর্ণতার চর্চা হবে, উদ্দীপ্ত করতে মিথ্যা গল্প শোনানো হবে। তা থেকে মোটিভেশনাল স্পিকার খ্যাত ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের কথামালায় প্রভাবিত ব্যক্তিরা যেন নিরাপদে থাকতে পারে। সে ব্যাপারে অল্প পরামর্শ তুলে ধরতে চাই।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অবশ্যই হিংসা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবে। কেননা আগুন যেভাবে কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়, অনুরূপভাবে হিংসাও মানুষের নেক আমলকে নষ্ট করে দেয়। ’ -আবু দাউদ
অনুমাননির্ভর কথাবার্তা বর্জন করা উচিত। কেননা এমন আলাপচারিতা মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা বেশি বেশি অনুমান করা থেকে বিরত থাকো। কেননা কোনো কোনো অনুমান গোনাহের কাজ। ’ -সুরা হুজুরাত : ১২
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অনুমান পরিহার করো। কেননা অনুমান হচ্ছে- নিকৃষ্টতম মিথ্যা কথা। ’ -সহিহ্ বোখারি
মোটিভেশন কিংবা ইন্সপিরেশন প্রদান করতে গিয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট কথাবার্তা পরিহার করা উচিত। আল্লাহর নির্দেশ, ‘এবং মিথ্যা কথা বর্জন করো। ’ -সুরা হজ : ৩০
মোটিভেশনাল স্পিচ মানুষকে উজ্জীবিত করে। কর্মে সক্রিয় বানায়। ঐক্যের সেতুবন্ধন রচিত হয়। এর মাধ্যমে আরও অনেক কল্যাণ সাধিত হয়। তাই প্রত্যাশা রাখি মোটিভেশনাল বক্তারা সুন্দরের চর্চা অব্যাহত রাখবেন। সোজা ও সহজ কথামালায় অভ্যস্ত থাকবেন। হাসিমুখে জাতিকে গাইডলাইন দেবেন। পরনিন্দা, বদনাম রটানো, অপবাদ দেওয়া, খোঁটা দেওয়া, হিংসা জাগ্রত করা, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া এবং কটু ভাষার ব্যবহারে মানুষকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।
শ্রোতাদের প্রতি অনুরোধ, সত্য আঁকড়ে ধরুন। মিথ্যা দূরে ঠেলে দিন। ভালো আর মন্দ কখনো এক হতে পারে না। যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিন। সত্য ও সুন্দরের চর্চায় এগিয়ে আসুন।
লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক