শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৩:২১ পূর্বাহ্ন
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ:
জনদুর্ভোগ কমানো এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বর্তমান সরকারের বিদ্যুৎ খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ দেশের বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি। আর এজন্য প্রয়োজনীয় যে বরাদ্দ রাখা এবং সংস্কার দরকার, সেটির দিকে নজর বাড়ানোর বিকল্প নেই। বিশেষ করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে অযৌক্তিক যেসব পরিকল্পনা সেগুলো রিভিউ করে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে এগোতে হবে। শ্বেতপত্র প্রণয়নে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত প্রাধান্য পাওয়ার কথা। জ্বালানি খাতের অন্যতম সমস্যা গ্যাস। এ ক্ষেত্রে আমদানি নির্ভরতার ওপর বসে না থেকে স্থানীয় গ্যাসের দিকে নজর দিতে হবে। এ ছাড়া বিশেষ বিধানের আওতায় যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে সেগুলোর চুক্তিতে কী রয়েছে, তা জনসাধারণের জানার সুযোগ করে দিতে হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ৩১ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। অথচ বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত। বাকি সক্ষমতা বসিয়ে রেখে চুক্তি অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। তারপরও অসম্ভব চড়া দাম ও শর্তে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু এসব চুক্তি রিভিউ করার তাগিদ জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের। তাতে কোন কেন্দ্রের প্রয়োজন রয়েছে, কোনটির নেই তা নির্ধারণ করা যাবে। আর যেগুলোর প্রয়োজন নেই সেগুলো অবসরে দেওয়া, বিশেষ করে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরে দেওয়ার দরকার হবে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে বিপিডিবি বিপুল পরিমাণ অর্থ যেমন গুনছে, তেমনি বিশেষ একটি শ্রেণি বিদ্যুৎ বিক্রি না করেও এ খাত থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে কিনা, সেটা স্পষ্ট করতে হবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উন্নয়নে বিগত সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেছে বিদেশি দাতাসংস্থাগুলোর কাছ থেকে। অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, অন্তত ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরকারের ঋণ গ্যারান্টি রয়েছে ৫১ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। ‘বিদ্যুৎ খাতে অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় সংযোজন করা হয়েছে। লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধি করে এ অর্থ ব্যক্তি হয়ে মুনাফা হিসেবে বিনিয়োগকারীদের পকেটে গেছে।’ অভিমত বিশেষজ্ঞদের। বিদ্যুতের যেসব চুক্তি বিগত বছরগুলোয় হয়েছে সেগুলো রিভাইজ হওয়া দরকার। বিশেষ বিধানের আওতায় দেওয়া এসব অনুমোদনে কী ছিল, কী ধরনের বিনিয়োগ আনা হয়েছে, কত শতাংশ সুদে ঋণ নেওয়া হয়েছে, ইকুইটি বিনিয়োগ কত ছিল এসব হিসাব হওয়া দরকার। প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা গড়ে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ সাশ্রয়ী করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের লুণ্ঠনমূলক এসব ব্যয় নিয়ে হিসাব করলে বোঝা যাবে, এ খাতে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে। কী পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা গেলে বিদ্যুতের দাম কতটুকু কমানো যেত।
কয়লাভিত্তিক চারটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বেশি হয়েছে। সেখানে অস্বচ্ছ ও অযৌক্তিক ব্যয় সংযোজন হয়েছে। অর্থাৎ লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধি করে এ অর্থ মুনাফা হিসেবে বিনিয়োগকারীর পকেটে গেছে। শুধু বিনিয়োগকারী নিয়েছে তা নয়। বিনিয়োগকারী নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তারাও ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এ চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেই অনেক অর্থ সাশ্রয় করা যেত কিনা, চুক্তি রিভিউ করলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক তো বাইরে থেকে আসেনি। সরকারি কোম্পানিই। এই চুক্তিগুলো যদি রিভিউ করা হয়, তাহলে ৩৫ হাজার কোটি টাকা না হোক অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। এ সাশ্রয় করতে হলে হিসাবপত্র নিয়ে বসতে হবে। এসব চুক্তি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০-এর আওতায় প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগ করা হয়েছে। কারা বিনিয়োগ করেছে, কী ধরনের ইকুইটি বিনিয়োগ এসেছে, কত শতাংশ সুদে ঋণ নেওয়া হয়েছে এবং ইকুইটি বিনিয়োগে কত শতাংশ মুনাফা দেওয়া হয়েছে, বিনিয়োগকারীকে কত শতাংশ রেট অব রিটার্ন দেওয়া হয়েছে, সেগুলো দেখতে হবে। বিইআরসি কর্র্তৃক ২০২২ সালে নির্ধারিত রেট অব রিটার্ন ছিল প্রায় ৬ শতাংশ। অথচ প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগে দেওয়া হয় ১৬-১৮ শতাংশ। বিদ্যুৎ বিভাগে নীতিনির্ধারক যারা, তাদের প্রত্যেকেই সরকারের মালিকানা সূত্রে কোনো না কোনো কোম্পানির মালিক হয়ে গেছেন। সেখানে বসে তারা যা খুশি তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারাই সরকারকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভোক্তা, দেশ ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেছেন। সুতরাং এসব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ব্যয় সাশ্রয় করার কৌশল যদি হাতে নেওয়া হয়, তাহলে তা সম্ভব। কোম্পানিগুলোকে এত বেশি মুনাফা কেন দিতে হবে? সরকার এখন মুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সাধারণ ভোক্তা এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের নামে এ মুনাফা আহরণ করছে মূল্যহার সমন্বয় করে। ফলে সরকার ছিল মুনাফাখোর। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিক্রি করে বিগত সরকার এভাবে মুনাফা করতে চেয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিকে বাণিজ্যিক পণ্য বানাতে চেয়েছে, মালিক হিসেবে শোষণ করতে চেয়েছে এবং প্রতিযোগিতা আইন অনুসারে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধি করতে চেয়েছে। যদি সেই ধারাই অব্যাহত থাকে তাহলে এই খাতে জ্বালানি নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে? কীভাবেই বা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ হবে?
পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে জনবল ব্যয় যদি জাতীয় বেতন স্কেলে হয়, তাহলে তাদের জন্য কোম্পানি নামক একটি শব্দ বসিয়ে সব সরকারি কোম্পানি দিয়ে বিদ্যুৎ খাত চালানোর পর তাদের বেতন বেশি দিতে হবে কেন? একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে বড়জোর সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন। তার বেশি লাগে না। একটি বিতরণ কোম্পানি চালাতে লাগে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী, ক্ষেত্রবিশেষে একজন সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার। সেখানে বেশি বেশি বেতন দিয়ে অনেক পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলী রাখা হয়। এভাবে যে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। হিসাবে দেখা গেছে, একটি কোম্পানি বছরে ২০-২২টি সভা করে। প্রতি সদস্যের প্রত্যেকটি সভায় সিটিং ভাতা যদি ১২ হাজার টাকা হয়, একই কর্তাব্যক্তি যিনি সাতটি কোম্পানির চেয়ারম্যান তিনি বেতনভুক সরকারি কর্মকর্তা হয়েও, তার বেতনের চেয়ে পাঁচ-ছয় গুণ টাকা এভাবে পেতে পারেন। অবশ্যই অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের মুনাফাখোরের চরিত্র অনুসরণ করবে না, এ প্রত্যাশা সব নাগরিকের। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের যে রূপান্তর ঘটেছে, সেই রূপান্তর যে চেতনার ভিত্তিতে হয়েছে সেটা হলো অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসমতা ও বৈষম্য রহিতকরণ। সেই অসমতা ও বৈষম্য যদি দূর করতে হয় তাহলে জ্বালানি খাত থেকেই শুরু করতে হবে। জ্বালানি খাতে প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত থাকার কারণেই নানা রকমের অসমতা ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এ খাতে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। যেসব ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারী নিয়োগ করা হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। গোষ্ঠীগতভাবে অনুরাগ দেখানো হয়েছে। লুণ্ঠনমূলক মুনাফা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের লাভবান করা হয়েছে, যে নিয়োগ করেছে সেও লাভবান হয়েছে। এখানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বড় রকমের বৈষম্যের শিকার হওয়ার কারণেই বর্তমানে অর্থনীতিতে এমন অন্তঃসারশূন্য পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, মুনাফা, মূল্যবৃদ্ধি এসব ঘটনা ঘটছে। সুতরাং রাষ্ট্রের যে রূপান্তর সে রূপান্ততরের মধ্যে এ রূপান্তরটা অঙ্গীভূত হতে হবে।
সরকারকে যদি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হয় অর্থাৎ পণ্য, সেবা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাহলে আগামী তিন বছরের মধ্যেই এ সমস্যা সমাধানের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নানা ধরনের সংস্কারের মধ্য দিয়ে এটি সুরাহা করা প্রয়োজন। এ সময়ের মধ্যে সরকারের কোনোভাবেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম আর বাড়ানো সমীচিন হবে না। বর্তমানে এই সরকারকে প্রয়োজনে শ্বেতহস্তিসম উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করে এ খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। এটি সবার জন্য কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। আর এ চ্যালেঞ্জ যদি মোকাবিলা করা না যায় তাহলে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুরক্ষা হবে না, কর্মসংস্থান হবে না, উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হবে। রপ্তানি হুমকিতে পড়বে এবং আরও আমদানিনির্ভর হতে হবে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দিন শেষে পাবলিক ইনকাম আরও সীমিত হয়ে পড়বে। ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে কতটা কৃচ্ছ্র সাধন করা যাবে সেটা বলা মুশকিল। অর্থাৎ সংকট নিরসনের সুযোগ বা সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা, জ্বালানি নিরাপত্তা সমুন্নত রাখাই সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। অন্যতম কাজ হবে ব্যয় সাশ্রয় করা ও ব্যয় বৃদ্ধির জায়গাগুলো চিহ্নিত করা। চিহ্নিত করে সেই ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনা।
লেখকঃ সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান
mazid.muhammad@gmail.com
ভয়েস/আআ/সূত্র: দেশরূপান্তর