রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:০৯ অপরাহ্ন
মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ:
ইসলাম ভারসাম্য পূর্ণ এক জীবনব্যবস্থা। এই ধর্ম শুধু মানুষকে ইবাদত-বন্দেগি করার কথাই বলে না, বরং মানুষের আরাম, অধিকার, মর্যাদা ও মানসিক স্বস্তিকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইসলামের প্রতিটি বিধানেই এই ভারসাম্য সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় এবং তাতে বান্দার হক সংরক্ষণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ওয়াজ-নসিহতের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের হৃদয়ে ইমানের আলো জ্বালানো, তাদের অন্তরকে আল্লাহমুখী করা এবং চরিত্রকে সুন্দর ও পরিশীলিত করে তোলা। দাওয়াত কখনোই মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করার, বিরক্তির কারণ হওয়ার কিংবা কষ্ট দেওয়ার মাধ্যম হতে পারে না। বরং তা হওয়া উচিত কোমল, শালীন ও প্রজ্ঞাপূর্ণ, যাতে মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট হয়, তারা দূরে সরে না যায়। মহান আল্লাহ তার রাসুল (সা.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘হেকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো।’ (সুরা নাহল ১২৫) এই আয়াতই প্রমাণ করে ইসলামে দাওয়াতের পদ্ধতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আমাদের সমাজে ওয়াজ মাহফিল ও ধর্মীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে মাইক ও লাউড স্পিকারের অপব্যবহার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অনেক সময় দেখা যায়, এমন উচ্চ আওয়াজে বক্তব্য প্রচার করা হয়, যা আশপাশের মানুষের জন্য বিরক্তি, অস্বস্তি ও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে শুধু যে ইবাদতের পরিবেশ বিঘিœত হয় তা নয়, বরং ইসলাম যে দয়া, সহনশীলতা ও মানবিকতার শিক্ষা দেয়, তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
একজন অসুস্থ মানুষ, একান্ত বিশ্রামরত বৃদ্ধ, পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত শিক্ষার্থী কিংবা গভীর রাতে ঘুমিয়ে থাকা শিশু, তাদের প্রত্যেকেরই ইসলামের দৃষ্টিতে অধিকার রয়েছে। তাদের এই স্বাভাবিক অধিকার লঙ্ঘন করে যদি দাওয়াত দেওয়া হয়, তাহলে তা ইসলামের শিক্ষা ও উদ্দেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। কারণ, ইসলাম কখনোই চায় না যে, আল্লাহর নাম উচ্চারিত হবে মানুষের কষ্টের বিনিময়ে।
ওয়াজ-মাহফিল নিঃসন্দেহে দ্বীন প্রচার-প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু এই পদ্ধতি তখনই প্রাণবন্ত ও কল্যাণকর হয়ে ওঠে, যখন সেখানে দাওয়াত দেওয়া হয় শালীনতা, প্রজ্ঞা ও সংযমের সঙ্গে। প্রযুক্তি আমাদের জন্য আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত, কিন্তু সেই নেয়ামত যখন সীমা অতিক্রম করে মানুষের জন্য যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা আর নেয়ামত না থেকে পরীক্ষায় পরিণত হয়। এই বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণী উল্লেখ করা হলো।
মাইকের ব্যবহার : প্রথমেই বুঝে নেওয়া জরুরি, মাইক বা লাউড স্পিকার ব্যবহার কোনো ইবাদত নয়, বরং এটি একটি সহায়ক উপকরণ মাত্র। শরিয়ত কোথাও খুতবা, নামাজ বা ওয়াজের জন্য মাইক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করেনি। কাজেই এর ব্যবহার হবে প্রয়োজন অনুযায়ী, এর বেশি নয়। আজানের ক্ষেত্রে দূর পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছানো একটি স্বীকৃত ও প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু ওয়াজ-নসিহত, বয়ান, খুতবা, কোরআন তেলাওয়াত বা জিকিরের আওয়াজ ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কোনো শরয়ি বাধ্যবাধকতা নেই।
ইসলামের মৌলিক নীতি হলো, ‘কেউ যেন অপরের জন্য কষ্টের কারণ না হয়।’ ফিকহের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আল-বাহরুর রায়েকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘ইমাম যদি মুসল্লিদের প্রয়োজনের সীমা অতিক্রম করে উচ্চৈঃস্বরে কেরাত পড়েন, তবে তিনি ভুল করেছেন।’ (আল-বাহরুর রায়েক ১/৩৩৭) অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত উচ্চ আওয়াজ শরিয়তের দৃষ্টিতে ত্রুটি।
বাস্তবেও আমরা দেখি, বাইরের লাউড স্পিকারের উচ্চ শব্দের কারণে আশপাশের নারী, বৃদ্ধ, রোগী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, এমনকি শিশু ও গর্ভবতী নারীরাও চরম কষ্টে পড়েন। অনেক সময় তারা নিজের ঘরে শান্তিতে নামাজ পড়তে, জিকির করতে বা বিশ্রাম নিতেও পারেন না। অথচ কারও ইবাদতে বিঘœ সৃষ্টি করা যে গুনাহ, এ বিষয়ে শরিয়তের অবস্থান একেবারেই স্পষ্ট।
শব্দ সংযমের শিক্ষা : ইতিহাস আমাদের শেখায়, শব্দ সংযম ইসলামি সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ওমর ইবনে শায়বা (রহ.) বর্ণনা করেন, মদিনায় এক ব্যক্তি হজরত আয়েশা (রা.)-এর ঘরের কাছে উচ্চৈঃস্বরে ওয়াজ করতেন। এতে তার একাগ্রতা নষ্ট হতো। বিষয়টি হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে পৌঁছালে তিনি বক্তাকে ওই স্থানে ওয়াজ করতে নিষেধ করেন। কিন্তু কিছুদিন পর সে পুনরায় ওয়াজের সিলসিলা চালু করায় ওমর (রা.) নিজে গিয়ে তাকে শাস্তির মুখোমুখি করেন। (আখবারুল মদিনা ১/১৫) এই ঘটনা প্রমাণ করে, ওয়াজ যতই দ্বীন প্রচারের মাধ্যম হোক, যদি তা অন্যের কষ্টের কারণ হয়, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
বিশিষ্ট তাবেয়ি হজরত আতা ইবনে আবি রাবাহ (রহ.) বলেন, ‘একজন আলেমের খেয়াল রাখা উচিত, তার কণ্ঠস্বর যেন তার মজলিসের সীমা অতিক্রম না করে।’ (আদাবুল ইমলা ওয়াল ইসতিমলা ৫)
ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি মানুষ ঘুমিয়ে থাকার মুহূর্তে নিজের বাড়ির ছাদে উচ্চ আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াত করে, তাহলে সে গুনাহগার হবে। (ফতওয়ায়ে শামি ২/৩২৯)
রাতভর মাইক ব্যবহার : আমাদের সমাজে ওয়াজ মাহফিলের সময় গভীর রাত পর্যন্ত চারদিকে মাইক লাগিয়ে উচ্চ আওয়াজে বয়ান চালানো হয়। এতে আশপাশের অসংখ্য মানুষের ঘুম, আরাম ও দৈনন্দিন জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। শিক্ষার্থী, পরীক্ষার্থী, গবেষক, অসুস্থ ব্যক্তি, এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও কষ্ট পান। অথচ ইসলাম কাউকে কষ্ট দিয়ে দাওয়াত দেওয়ার অনুমতি দেয় না।
হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদা রাসুল (সা.) মসজিদে ইতিকাফ অবস্থায় সাহাবিদের উচ্চৈঃস্বরে কেরাত পাঠ করতে শুনে পর্দা উঠিয়ে বলেন, জেনে রাখো, তোমরা প্রত্যেকেই তোমাদের রবের সঙ্গে গোপন আলাপে রত আছ। অতএব, তোমরা (উচ্চৈঃস্বরে কেরাত পাঠের দ্বারা) একে অন্যকে কষ্ট দিয়ো না, তোমরা একে অন্যের চেয়ে উচ্চৈঃস্বরে কেরাত পাঠ কোরো না।’ (সুনানে আবু দাউদ ১৩৩২)
এ হাদিস প্রমাণ করে, উচ্চ আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াতও যদি অন্যের জন্য কষ্টের কারণ হয়, তবে তা নিষিদ্ধ। তাহলে ওয়াজ মাহফিলের মাইক নিয়ে আমাদের আরও কত বেশি সতর্ক হওয়া উচিত!
যেখানে ব্যাপক জনসমাগম হয় এবং উপস্থিত লোকদের শোনানোর জন্য প্রয়োজন, সেখানে সভাস্থলের ভেতরে সীমিত পরিসরে মাইক ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু অপ্রয়োজনীয়ভাবে বাইরে বড় স্পিকার ব্যবহার করা, বিশেষ করে রাতের বেলায় কোনোভাবেই উচিত নয়।
ওয়াজ-মাহফিল, খুতবা ও দাওয়াত নিঃসন্দেহে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এবং দ্বীনের এক মহান ইবাদত। তবে মনে রাখতে হবে, ইবাদতের আসল সৌন্দর্য নিহিত থাকে তার প্রভাব ও ফলাফলে। যে আমল মানুষের অন্তরে নুর জাগ্রত করার পরিবর্তে কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যে দাওয়াত আল্লাহর দিকে আহ্বান করার বদলে মানুষের শান্তি ও স্বস্তি বিনষ্ট করে, তা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য উপযুক্ত হতে পারে না।
এ কারণে আমাদের দায়িত্ব ও সচেতনতা অপরিহার্য। মাইক ও শব্দযন্ত্রের ব্যবহার হতে হবে কেবল প্রয়োজনের সীমার মধ্যে। যেখানে ভেতরের ব্যবস্থাতেই কাজ চলে, সেখানে বাইরের লাউড স্পিকার ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত। বিশেষ করে আমাদের আশপাশে বসবাসকারী বৃদ্ধ, অসুস্থ, দুর্বল, নারী ও শিশুদের অবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ইসলামি শিষ্টাচারেরই অংশ। কারণ, ইসলাম কখনোই কারও জন্য কষ্টের কারণ হওয়াকে ইবাদতের অংশ হিসেবে অনুমোদন দেয় না।
দাওয়াতের প্রকৃত রূপ হলো, হেকমত, শালীনতা ও রহমতের সঙ্গে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া। কণ্ঠের উচ্চতা নয়, বরং বক্তব্যের গভীরতা ও আন্তরিকতাই হৃদয় জয় করে। অতএব, আমাদের প্রত্যেকের উচিত, দাওয়াত ও ওয়াজের ক্ষেত্রে এই ভারসাম্য ও সংযম বজায় রাখা।
মহান আল্লাহ যেন আমাদের দাওয়াতকে হেকমতপূর্ণ করেন, আমাদের কণ্ঠকে রহমতের বাহক বানান এবং আমাদের আমলকে মানুষের জন্য উপকার ও শান্তির উৎস হিসেবে কবুল করেন। আমিন।
লেখক : মুদাররিস, জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া, কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা
ভয়েস/আআ