রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ১১:২৪ পূর্বাহ্ন
এম এ সাত্তার:
উজাড় হয়ে যাচ্ছে কক্সবাজারের হাজার হাজার একর বনের মুল্যবান বনসম্পদ। যেযেমন পারছেন তেমন করেই বনের গাছ কেটে বিক্রি করে আসছে।আর এসব করতে দায়িত্বরত বন কর্মীদের দিতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। আর এতে বনের গাছ কাটার অনুমতি মিলছে অবৈধ কাঠ ব্যবসায়ীদের।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের আওতাধীন পিএমখালী রেঞ্জের আওতাভুক্ত বিভিন্ন বন বিটের মধ্যে থেকে কর্তন করে পিএমখালীর চেরাংঘর বাজার চমোহনী , বাংলাবাজার, রাবার ড্রাম, খুরুশকুল কুলিয়া পাড়া পয়েন্ট দিয়ে দিয়ে প্রতিদিন অবাধে পাচার হচ্ছে লাখ লাখ টাকার সরকারী কাঠ। পিএমখালী রেঞ্জের অসাধু কর্মকর্তা, কর্মচারীদের যোগসাজশে প্রতিরাতেই পাচার হয় এসব কাঠ। কাঠ পাচারে দৈনিক লাখ টাকার অধিক টাকা অবৈধ লেনদেন হয় জানান প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তি। অভিযোগ উঠেছে মাসোহারা পেয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দিঘীরঘোনা বিটের আওতাধীন সামাজিক বনায়নের জমির মধ্যে উঠা গাছ কাটা হচ্ছে। শ্রমিকরা গাছের পাতা ও গাছের গুঁড়ি সরানোর কাজ করছেন। পাশেই কেয়ার টেকার মেহের আলী মিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে গাছ কাটা বন্ধ রাখেন শ্রমিকরা। গাছ কাটারত এক শ্রমিক জানান, এখানে গাছ কাটতে প্রবাসী জাহাঙ্গীর আলমের পুত্র জুলহাস নামের এক ব্যক্তি তাদের নিয়ে এসেছেন। শুনেছেন দুই লাখ টাকায় এই গাছগুলো কিনেছেন তিনি। এ সময় বিট কর্মকর্তাকে অবহিত করলে সে আগ বাড়িয়ে জানান, নিজেদের কাঠ নিজেরা কেটে বিক্রি করছে তার করার কিছু নেই। সে জুমছড়ি এলাকায় অবস্থান করছেন।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, বনবিভাগ এবং স্থানীয় কাঠ চোর সিন্ডিকেটের দ্বিপক্ষীয় যোগসাজশে ব্যাপক কাঠ পাচার হয়ে আসছে উক্ত রেঞ্জের বিভিন্ন সড়ক দিয়ে। এদিকে পিএমখালীর বিট ও রেঞ্জ অফিসের সাথে সংযুক্ত বাংলাবাজার, খুরুশকুল সড়ক দিয়ে প্রতিদিনই ভ্যানগাড়ি, টমটম, পিকআপ,ট্রাকে করে হাজার হাজার টাকার বিভিন্ন প্রজাতির মূল্যবান কাঠ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন অনুমতি ছাড়াই নিয়ে যেতে দেখা যায়। মাঝে মধ্যে বন অফিসের নির্ধারিত উৎকোচ না দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঠবাহী গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখেন বিট অফিসার মোশাররফ হোসেন। পরে বিট কর্মকর্তার চাহিদা মাফিক টাকা দিয়ে কাঠের গাড়ী নিয়ে যান অবৈধ কাঠ বিক্রেতারা। প্রতিদিন পিএমখালীর বন কর্মচারীরা এভাবে হাজার হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে ভাগবাঁটোয়ারা করেন বলে জানান স্থানীয়রা। আবার যেসব অবৈধ সেগুন,গামারী কাঠ নিয়ে যেতে চাঁদার অংক (লাইনের টাকা) দ্বিগুণ দিতে হয়। এসব গাড়ীকে বিট ও রেঞ্জ অফিস অতিক্রম করতে ডিউটিরত বন কর্মকর্তাদের ভ্যানগাড়ি প্রতি দেড়হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এভাবে দৈনিক ১ থেকে ২ লাখ টাকার মতো চাঁদাবাজি হচ্ছে পিএমখালীর রেঞ্জ অফিসে। অথচ বনভূমি সুরক্ষা ও অবৈধ কাঠ পাচাররোধে রেঞ্জের আওতাভুক্ত একাধিক বিট অফিস বসানো হলেও বিট অফিসগুলোতে দায়িত্বরত লোকজন পাচাররোধের পরিবর্তে বনের জমি জবরদখল, বিক্রি, পাহাড় কাটা, কাঠ পাচারের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। এতে করে কক্সবাজারের বিশাল বনসম্পদ দিন দিন বিরাণ ভূমিতে পরিণত হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, জেলার বিভিন্ন রেঞ্জের আওতাভুক্ত বনবিটের আওতাধীন এলাকায় সরকারী অর্থে ও প্রাকৃতিকভাবে সৃজনকৃত সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে পাচারকারীরা দিনে ও রাতে সেগুন, চাপালিশ, গামারী, কড়ই, গর্জন, আকাশমনি, জামগাছসহ নানা প্রজাতির ছোট-বড় গাছ কেটে সরকারী বাগান সংলগ্ন নিরাপদ জায়গায় স্তুপ করে রাখে। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এসব কাঠ গাড়ীভর্তি করে রাতভর পাচার করে স্থানীয় উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটা ও স’মিলে। বর্তমানে বনসম্পদ রক্ষা কাজে দায়িত্বরত বনবিট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রক্ষকের পরিবর্তে ভক্ষকের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছে। বিট,রেঞ্জ অফিসে কর্মকর্তা- কর্মচারীরা ঘুষের বিনিময়ে জবরদখলকারীদের হাতে বন সম্পদ তুলে দিয়ে যে যেভাবে পারে লুটেপুটে খেয়ে অন্যত্রে বদলী হয়ে যাওয়ার আগেই নিরীহ কয়েক ব্যক্তিকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দিয়ে চলে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। জনশ্রুতি আছে, বনবিভাগের কোন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা যদি কোনভাবেই খবর পেয়ে বিশেষ অভিযানে নামে তখন অসাধু বনকর্মকর্তা- কর্মচারীরা মাটি-বালি, গাছপাচারকারীদের কাছে সে খবর দ্রুত পৌঁছে দেয়। এতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অভিযান নিষ্ফল হয়।
অন্যদিকে রাত ১০টা পেরুলেই শুরু হয় টলিভ্যান, ডাম্পারভার্তি কাঠ পাচারের প্রতিযোগীতা। এসময় বিট অফিস ও রেঞ্জ অফিসের সামনে দিয়ে কাঠভর্তি গাড়ি লাইনে লাইনে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হয়। আর রেঞ্জারের নামে চলে চাঁদাবাজি। আবার রেঞ্জ অফিসের নামে চাঁদা আদায়ে নিয়োজিত থাকেন স্ব-স্ব এলাকার বিট কর্মকর্তা এবং নিজস্ব একটি আদায়কারী সিন্ডিকেট। এবিষয়ে চাঁদা আদায়কারী সেন্ডিকেটের সদস্যদের নিকট জানতে চাইলে তারা কোন ধরণের তথ্য দিতে নারাজ।
তবে, স্থানীয় কয়েক কাঠ ব্যবসায়ী জানান,যে কারো বাড়িভিটা বা পাহাড় বনের কাঠ হোক না কেন যানবহন করে গাছ নিয়ে আসতে হলে ফরেষ্ট অফিসে গিয়ে আছে কথা বলে কর্মকর্তারদেরকে নির্ধারিত হারে গাড়ি প্রতি চাঁদা দিতে হয়।বিট ও রেঞ্জ কর্মকর্তা এমনভাবে সোর্স লাগিয়ে রেখেছেন এদের ফাঁকি দিয়ে এক ইঞ্চি কাঠ এদিক ওদিক করার কারো কোন সুযোগ নেই। ভাগ্যক্রমে এদের অজান্তে এক গাড়ি কাঠ নিয়ে যাওয়া হলে পরবর্তীতে কোন মাধ্যমে জানতে পারলে ভয়ভীতি দেখিয়ে ডাবল টাকা আদায় করে নেন তারা।
কাঠ ব্যবসায়ী আবুল কাসেম বলেন, বনবিভাগকে চাঁদা দেবার বিয়য়টি অনেক পুরোনো ব্যাপার। বৈধভাবে গাছ নিয়ে আসছেও তাদেরকে কিছু টাকা দিতে হয়। আবার যারা অবৈধভাবে নিয়ে আসছেন তাদের কাছ থেকে ২ হাজার থেকে শুরু করে যত পারে তত টাকা নিয়ে থাকে বনকর্মীরা। কোনো কোনো সময় পরিমাণমতো চাঁদা না পেলে টাকা দেওয়া না পর্যন্ত কাঠ বহনকারী গাড়িগুলো রাস্তার পাশে আটক করে রাখা হয়।
এক ডাম্পার চালক জানায়, কাঠবাহী গাড়ী নিয়ে সমিলে এলাকায় ডুকার সময়ে আশেপাশে কোন লোক দেখতে পাওয়া যায় না কিন্তু গাড়ির আনলোড করার সময়ে হঠাৎ জিনের মতো ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেরা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন।তখন কাঠের ক্যাটাগরি অনুযায়ী সর্বনিম্ন ১৫’শ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত টাকা দিতে হয় তাদের।
পিএমখালীর ছনখোলা ফরেস্ট বিট দিঘীরঘোনা বিট কর্মকর্তা মোশাররফ বলেন, রাত ১০ টার দিকে টলি ভ্যান গাড়িভর্তি করে বনের গাছ পাচার হওয়ার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে একটি গাড়ি হাতেনাতে ধৃত করেন। এর কিছু সময়ের মধ্যেই কাঠ বিক্রেতা-ক্রেতা পিএমখালীর নয়াপাড়া এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান প্রার্থী সৈয়দ নুরের ভাই মোঃ নুর ধৃত কাঠের গাড়ির সামনে উপস্থিত হয়। এবং সে পরবর্তীতে কোন সময় বনের কাঠ ক্রয় করবে না বলে স্থানীয়দের সামনে বারবার প্রতিজ্ঞা করেন। তাই তাকে কিছু নগদ টাকা পানিশমেন্ট করে ছেড়ে দেয় বলে স্বীকার করেন বিট কর্মকর্তা মোশাররফ। এরপরে ২০-৩০ মিনিটের ব্যবধানে একসাথে লাইনবাইলাইন করে আরো তিন গাড়ি কাঠ নিয়ে গিয়েছে বলে জানালে উক্ত বিট কর্মকর্তা মোশাররফ আমতাআমতা করে কোন সদুত্তর না দিয়ে মুঠোফোনে রেখে দেন।
সহকারী বন সংরক্ষক (উত্তর) প্রান্তোষ চন্দ্র রায় জানান, বিট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিউজ ও অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নিবেন।
ভয়েস/জেইউ।