মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:৫৯ অপরাহ্ন
হুদা আল-মারাশি:
গাজার চলমান ধ্বংসযজ্ঞ এবং ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণের মধ্যে আশ্চর্য রকম মিল রয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে, ফিলিস্তিনি সাংবাদিক প্লেস্তিয়া আলাকাদ ইনস্টাগ্রামে করা এক পোস্টে বলেছিলেন, ‘আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে আমরা যখন শুনি যে একজনকে টুকরো করে হত্যা করা হয়েছে তখন আমরা খুশিই হই।’ কথাটি কেবলমাত্র ভীতিকর বলেই নয়, বরং এই পরিস্থিতি আমার পরিচিত বলে আমাকে এক হিমশীতল অনুভূতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ইরাক যুদ্ধের চরম মুহূর্তে যখন আমার দাদা মারা যান, তখন আমাদের ইরাকি-আমেরিকান অভিবাসী স্বজনরা সান্ত¡না দিয়ে বলত যে, ‘তোমরা অন্তত কবর দেওয়ার জন্য একটা লাশ পেয়েছ’। ওই সময়ে ইরাকে একটি যথাযথ সৎকারের সুযোগ পাওয়া ছিল বিলাসিতা। গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকে বিষয়টি আমাকে তাড়া করে ফিরছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন বলেন, হামাস ‘দুনিয়াতে নিখুঁত এবং নিষ্কলুষ অশুভকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে’; তখন সেটাকে আমার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ‘শয়তানের অক্ষ’ শীর্ষক বক্তৃতারই প্রতিধ্বনি বলে মনে হয়। বুশের যুক্তি ছিল, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে না থাকলে সন্ত্রাসীদের পক্ষে আছেন’। গাজার স্কুল, গির্জা, হাসপাতালে ইসরায়েলের বোমা হামলার ন্যায্যতা দিতে হামাসের ‘মানব ঢাল’ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে বিবৃতি দেওয়া হলে আমার ফের অতীতের কথাই মনে পড়ে যায়। ইরাকে আগ্রাসনের সাফাই হিসেবে তারা বলেছিল দেশটির কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে এবং তারা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেয় বলে সেখানে আমাদের ‘তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ’ করা দরকার হয়ে পড়েছিল।
অতি সম্প্রতি, ইসরায়েলি সৈন্যদের দ্বারা ফিলিস্তিনি পুরুষদের নির্যাতিত হওয়ার কিছু ভয়ংকর ভিডিও প্রকাশ পায়। যা আবু গারিব কারাগারে ইরাকি বন্দিদের ওপর মার্কিন সেনাদের চালানো নির্যাতনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এসব সাদৃশ্য ও মিলের যদিও শেষ নেই, তবে আমি তা নিয়ে বাড়াবাড়িও করতে চাই না। ইরাক এমন একটি দেশ যেখানে নির্দিষ্ট সীমানা এবং নিজস্ব সামরিক বাহিনী আছে আর নিজেদের সম্পদের ওপর দেশটির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরাকে একটি কৌশলগত আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল, বিপরীতে আমরা এখন কার্পেট বোমা হামলার মাধ্যমে গণহত্যা প্রত্যক্ষ করছি। তাছাড়া ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের কারণটি ব্যাপকভাবে নিন্দিত হয়েছে।
আমি কেবল জিজ্ঞাসা করার জন্য এই তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরছি যে, আমাদের দেশের বিপথগামী পররাষ্ট্রনীতির কারণে ৩০০,০০০ এরও বেশি বেসামরিক ইরাকি জীবন হারিয়ে যাওয়ার পরে, কীভাবে আমরা জনগণ হিসেবে এখনো আমাদের রাজনীতিবিদদের যুদ্ধের ন্যায্যতাগুলোতে বিশ্বাস করতে পারি? এই রক্ত এখনো আমাদের হাতে তাজা, এখন যুদ্ধবিরতি যে পরম বাধ্যতামূলক বিষয়, এতে কি কোনো দ্বিমত থাকতে পারে? ইরাকের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছিল, আমার আশঙ্কা এবারও আমরা শুধু হামলার কারণটা নিয়েই শোক করব, যা ফিলিস্তিনে এই ব্যাখ্যাতীত সংখ্যক মৃত্যু এনেছে, এবং সেটা এমন সময় যখন অনেক দেরি হয়ে যাবে।
আজ খুব কম মানুষই ইরাক যুদ্ধকে ন্যায়সংগত বলবে, তবে আমার এখনো মনে পড়ে বিমানবন্দরে একজন অল্পবয়সী নারীর কথা, যে এই যুদ্ধের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিল এই বলে ‘কিন্তু তারা (ইরাক) কী করবে সেটা তো আমরা জানি না।’ আরেক নারী আবার এ নিয়ে লেখা আমার প্রবন্ধের সমালোচনা করে বলেছিল লেখাটা রাজনৈতিকভাবে সঠিক হলেও সস্তা যুক্তি, যেখানে কিনা আমরা ‘ইরাককে মুক্তি দিয়েছি’। অসংখ্যবার আমি এই প্রশ্নের মুখে পড়েছি যে কেন মুসলমানরা সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানায় না, যেন বা সারা বিশ্বের প্রায় দুই কোটি মুসলমানের কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রয়েছে যারা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ বন্ধে একটা গণবিবৃতি দেবে।
এটা একটা স্বস্তির বিষয় যে এখন আর ইরাক যুদ্ধের অনৈতিকতা নিয়ে তর্ক করতে হয় না, কিন্তু ভয়াবহ ব্যাপার হলো যুদ্ধের সেই একই রকম ডিসকোর্স এখন আবার মানুষের মুখে শোনা যাচ্ছে। বাইডেন সন্ত্রাসবাদের হুমকির অপব্যবহার করছেন এই বলে, ‘ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যে সন্ত্রাসীদের যদি তাদের সন্ত্রাসের মূল্য দিতে না হয়, তাহলে তা আরও অশান্তি, আরও মৃত্যু আর ধ্বংস ডেকে আনে।’ অন্যদিকে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা আতঙ্কগ্রস্ত ফিলিস্তিনি অতিথিকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কিন্তু আপনি কি হামাসের নিন্দা জানান?’ রাজনীতিবিদ আর বিশ্লেষকরা ইসরায়েলের ‘নিজেদের রক্ষার অধিকারের’ কথা বলেন, যেখানে এটা পরিষ্কারভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এই ‘আমরা বনাম তারা’ ভাষ্য এখন অনলাইন, কর্মক্ষেত্র, স্কুলসহ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, যখন একটি চরম মানবিক সংকট চলছে তখন আমাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করা হচ্ছে।
প্রায় ৪০ বছর ধরে আমরা সাংবাদিকের লেন্স এবং সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি এই জাতিগত হত্যাকাণ্ডের কথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি এক পিতার হাতে তার মৃত শিশুদের খণ্ড-বিখণ্ড মরদেহ, মায়ের বুকে জড়ানো চাদরে ঢাকা শিশু, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সন্তানের নাম ধরে ডাকতে থাকা পিতার আকুতি, যদি কোথাও একটু জীবনের স্পন্দন পাওয়া যায়! শিশুদের শরীরে পরিবারের সদস্যরা নাম লিখে রাখছে, যাতে তাদের মরদেহ চিহ্নিত করা যায়, আবার পরে খণ্ডিত দেহে সেই নামগুলো খুঁজে ফিরছে তারাই। এমনকি পশুদেরও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না, আল শিফা হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপে ক্ষুধার্ত কুকুরদের দেখা যাচ্ছে মরদেহ খেতে।
আমার মন সেই সময়ে ফিরে যাচ্ছে, যখন আমরা শেষকৃত্য বা আত্মীয়কে কবর দেওয়ার মতো বিলাসিতা করতে পারতাম, দুঃখের বিলাসিতা, কেউ আমাদের ক্ষতির জন্য সহানুভূতি দেখাচ্ছে, সেই বিলাসিতা। যারা কখনো প্রিয়জন হারিয়েছেন, তারা সবাই জানেন শেষকৃত্যের চেয়ে ভয়ানক আর কিছু হতে পারে না। আর যদি প্রিয়জনকে ঠিকভাবে কবরই দেওয়া না যায়, সেই দুঃখ সারা জীবনেও মিটবে না। যুদ্ধের পর আমরা নিজেদের এই বলে সান্ত¡না দিই যে, হয়তো আমরা এখান থেকে কিছু শিক্ষা পাব, হয়তো একটু বেশি নিরাপদ, প্রজ্ঞাবান পৃথিবী পাব এতগুলো মৃত্যুর বিনিময়ে।
মাত্র ২০ বছর আগে আমাদের কাছে যে অন্যায় যুদ্ধ বিক্রি করা হয়েছে, আমি ভেবেছিলাম আমরা তা থেকে এই নিজেদের রক্ষার আড়ালে রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক এজেন্ডাগুলো আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব। এবং একদিন আমরা শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারব আমরা সবাই আসলে একটাই পক্ষ, সেটা হলো মানবিকতার পক্ষ। সেই দুর্বল মানুষের পক্ষে, যারা ক্ষমতাসীনদের আদেশের বলি হন, এমন সব নেতার নিয়ন্ত্রণে যারা আমাদের স্বার্থে কাজ করেন না।
লেখক : সাহিত্যিক এবং কলামিস্ট মিডিলইস্ট আই থেকে ভাষান্তরিত
ভয়েস/আআ