শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৪১ অপরাহ্ন
ধর্ম ডেস্ক:
মাতৃত্ব একজন নারীর পরম আরাধ্য এক অনুভূতি। তবে এই অনুভূতিকে তিক্ত করে দিতে পারে গর্ভকালীন সমাজে প্রচলিত কিছু কুসংস্কার। গ্রামগঞ্জের এমনকি শহুরে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান এ জাতীয় কুসংস্কারগুলো হলো-
মা বেশি খেলে তার বড় বাচ্চা হবে, হাঁসের ডিম খেলে বাচ্চার চোখ সুন্দর হবে, মা যদি গলায় মালা পরে তাহলে পেটের ভেতর বাচ্চার গলায় নাড়ি পেঁচিয়ে যাবে, জোড়া কলা বা দুই কুসুম আছে এমন ডিম খেলে যমজ বাচ্চা হবে, চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সময় এবং অমাবস্যায় গর্ভবতী নারী ঘরের বাইরে যেতে পারবে না বা কিছু কাটাকাটি করতে পারবে না। এরূপ করলে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হবে, মৃত ব্যক্তির কাছে গেলে মৃত সন্তান হবে (তবে মাকে আকস্মিক ভয় বা মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখার জন্য হলে ভিন্ন কথা), মৃগেল বা নির্দিষ্ট কোনো মাছ খেলে বাচ্চার ক্ষতি হবে, ডিম বা ডাব খেলে বাচ্চার চোখের ক্ষতি হবে, গর্ভবতী নারী মুরগি বা হাঁস জবাই করলে তা তার সন্তানের ক্ষতির কারণ হবে, খাবারের থালা চেটে খেলে কন্যাসন্তান হবে, বাসায় গর্ভবতী কেউ থাকলে বাজার থেকে মাছ আনা যাবে না; আনলেও তাতে আগুনের স্পর্শ লাগিয়ে ঘরে প্রবেশ করাতে হবে ইত্যাদি। এই রকম অনেক বাধা-নিষেধ অনাগত বাচ্চার মায়ের ওপর চাপানো হয়।
এভাবে বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পর নবজাতককে কেন্দ্র করে বহু কুসংস্কার সমাজে প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ দুটি হলো- নবজাতকের মাথার পাশে ম্যাচের বাক্সের ভেতর দিয়াশলাইয়ের কাঠি, রসুন, লৌহ পদার্থ ইত্যাদি এই আশায় রাখা যে, এগুলো খারাপ জিন-ভূত থেকে রক্ষা করবে এবং বদনজর থেকে বাঁচানোর জন্য বাচ্চার কপালে কালো টিপ/কাজল দেওয়া।
উল্লিখিত লোকাচার, কর্মকাণ্ড, বিশ্বাস ও বিষয়সমূহ ইসলামের দৃষ্টিতে ভ্রান্ত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। কোরআন-হাদিস তো বটেই, আধুনিক বিজ্ঞানেও এসবের কোনো উল্লেখ নেই। ইসলাম কোনোকিছুকে অশুভ মনে করা কিংবা কুলক্ষণে বিশ্বাস করাকে কঠিনভাবে নিষেধ করেছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো বস্তুকে কুলক্ষণ ভাবা শিরক।’ একথা তিনি তিনবার বলেছেন। -সুনানে আবু দাউদ : ৩৯১০
দ্বিতীয়ত, সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে, বাচ্চা একটা হবে নাকি যমজ তা সম্পূর্ণই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। কোনো কিছু খাওয়া বা না খাওয়ার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি (আল্লাহ) যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদের পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা করেন বন্ধ্যা।’ -সুরা আশ-শুরা : ৪৯-৫০
তৃতীয়ত, জিন ও মানুষের নানারকম ক্ষতি থেকে বাঁচতে একজন মা গর্ভকালীন বেশি বেশি ইবাদত, জিকির-আজকারে মশগুল থাকবেন। বিশেষ করে তিন কুল (সুরা ইখলাস, ফালাক, নাস), আয়াতুল কুরসি ও সুরা বাকারাসহ হাদিসে বর্ণিত সকাল-সন্ধ্যার জিকিরসমূহ নিয়মিত পাঠ করবেন। আল্লাহতায়ালার কাছে বেশি বেশি দোয়া-ইস্তেগফার করবেন। হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ এড়িয়ে চলবেন। বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরও এই আমলগুলো করে যাবেন- যাতে করে বাচ্চা বদনজর ও খারাপ জিনের প্রভাব থেকে বেঁচে থাকতে পারে। বিশেষ করে নিজে কোরআন তেলাওয়াত করতে না পারলেও ঘরের কেউ যেন সুরা বাকারা তেলাওয়াত করে। হাদিসে এসেছে, ‘যে বাড়িতে সুরা বাকারা পাঠ করা হয়, সে বাড়ি থেকে শয়তান পলায়ন করে।’ -সহিহ মুসলিম : ৭৮০
আর কেউ আপনার সামনে বাচ্চার প্রশংসা করলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে বারাকাল্লাহ, মাশাল্লাহ, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ বলার অনুরোধ করবেন। যার ফলে বদনজর লাগবে না। এসব আমল হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। -সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৫০৯
এছাড়া বাচ্চার নিরাপত্তার জন্য নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়তে পারেন, যা স্বয়ং রাসুল (সা.) স্বীয় নাতি হজরত হাসান-হোসাইন (রা.)-এর জন্য পড়তেন।
উচ্চারণ : আউজু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন কুল্লি শাইত্বানিন ওয়া হাম্মাতিন ওয়া মিন কুল্লি আইনিন লাম্মাহ।
অর্থ : আমি আল্লাহর কাছে তার পরিপূর্ণ বাক্যের মাধ্যমে প্রতিটি শয়তান এবং বিষধর বস্তু ও অনিষ্টকারী বদনজর থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৫২৫
মনে রাখতে হবে, একজন মা গর্ভকালীন শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে অনেক কঠিন সময় পার করেন। এই সময়টাকে আরও বেশি কঠিন করে তোলে প্রচলিত কুসংস্কার। তাই মা ও বাচ্চার স্বার্থেই এরূপ ভ্রান্ত বিশ্বাসগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আর বদনজরের কারণে বাচ্চা ও মা উভয়েই পরবর্তী সময়ে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। তাই এসব থেকে সাবধান থাকা উচিত।
ভয়েস/আআ