বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৭ পূর্বাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা ও গণহত্যায় বিপর্যস্ত গাজা। পবিত্র রমজানে তাদের ইফতার করতে হচ্ছে ঘাস দিয়ে। পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে বিশ্ব জুড়ে। অন্যরা যখন যথাযথ নিয়ম মেনে, নিজের পছন্দমতো রমজান পালন করছে, গাজায় তখন চলছে বিভীষিকা। আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, গাজাবাসী ইফতার করছে ঘাস বা গাছের পাতা দিয়ে। তারা তারাবিহর নামাজ পড়তে পারছে না। ওজু করার জন্য পর্যাপ্ত পানি নেই। সাহরিতে একজনের খাবার কয়েকজন ভাগ করে খাচ্ছে। এমন করুণ পরিস্থিতি পৃথিবীবাসী আগে কখনো দেখেনি। গাজাবাসীকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য মুসলিম বিশ্বের যে উদ্যোগ প্রয়োজন তাও অনুপস্থিত। কবে থামবে এ যুদ্ধ কেউ জানে না। এমনকি যুদ্ধবিরতির উদ্যোগও থেমে আছে।
গাজার মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস গত বছরের ৭ অক্টোবর দখলদার ইসরায়েলি সীমান্তে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১২০০ জনকে হত্যা এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করার পর গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। তারপর থেকে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৩১,৩০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যার মধ্যে ৭২ শতাংশ নারী এবং শিশু। ৭৩ হাজারের বেশি আহত হয়েছে এ যুদ্ধে। চিকিৎসকরা সিএনএনকে জানিয়েছেন, নবজাতকসহ এখন পর্যন্ত অন্তত ২৭ জন অনাহারে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে দুজন রমজানের প্রথম দিনগুলোতে অপুষ্টিজনিত কারণে মারা গেছেন।
ঘাস ও গাছের পাতা
মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটর সোমবার তাদের ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায় দেখা যায়, এক বয়স্ক ফিলিস্তিনি নারী পবিত্র রমজানে ইফতারের জন্য ঘাস তৈরি করছেন। তিনি জানান, আগের দিন তার ৩০ জন মিলে থাইম (ধনিয়া পাতার মতো) এবং তেলসহ এক প্লেট ভাত খেয়েছেন পানিতে ভিজিয়ে।
মিডলইস্ট মনিটর জানাচ্ছে, এটি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় খাদ্য সরবরাহের তীব্র সংকটের বহিঃপ্রকাশ। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো ক্ষুধায় কয়েকজনের মৃত্যুসহ গাজায় দুর্ভিক্ষ বিষয়ে সতর্ক করছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসকে মিসেস আলতাতার বলেন, গাজার মানুষ এতটা ক্ষুধার্ত যে কেউ কেউ পাতা ও পশুর খাদ্য খেয়েছে। আমরা প্রায় মাসখানেক ধরে উপবাস করছি। রমজানের আগে, আমরা পর্যাপ্ত খাবার খুঁজে পেতে সক্ষম হলে দিনে দুই বেলা খাবার খাচ্ছিলাম। অন্যথায়, আমরা সূর্যাস্তের সময় দিনে মাত্র একবার খেতে পারতাম।
সিএনএন তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, গাজার উত্তরে খাদ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি বলে জানা গেছে। সেখানে কেউ কেউ বলছে তারা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাবার ও পানি থেকে বিরত আছে শুধু রমজানের কারণে নয়, এর আগেও তাদের অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। শিশুরা মরিয়া হয়ে আবর্জনা খুঁজছে।
রাফাহতে বাস্তুচ্যুত সাংবাদিক আসিল মুসা (২৬) সিএনএনকে বলেন, আমরা রমজানের জন্য অপেক্ষা করি কারণ এটি আশীর্বাদ, শান্তি এবং উপাসনার মাস। কিন্তু এই রমজান আসছে গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে।
আলজাজিরা জানায়, জাতিসংঘ খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য সরবরাহের জন্য উত্তর গাজায় প্রবেশে অসুবিধায় পড়েছে। ওই অঞ্চল জুড়ে গাজাবাসী রমজানে আরও তীব্র অভাব অনুভব করছে। গাজার দক্ষিণ সীমান্ত শহর রাফাহ’তে দেড় মিলিয়ন ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছে। বাস্তুচ্যুত খান ইউনিসের বাসিন্দা মোহাম্মদ আল-মাসরি বলেন, বাস্তুচ্যুত মানুষের কী আছে, আমরা রমজানের আনন্দ অনুভব করি না… ঠাণ্ডায় তাঁবুতে থাকা লোকজনের দিকে তাকান। জাকি আবু মনসুর (৬৩) বলেন, আমরা জানি না আমরা রোজা ভাঙতে কী খাব। আমার কাছে শুধু একটি টমেটো এবং একটি শসা আছে… এবং আমার কাছে কিছু কেনার টাকা নেই।
গাজা জুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস পবিত্র রমজান মাসে যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সংঘাত অব্যাহত রয়েছে বলে আমি আতঙ্কিত এবং ক্ষুব্ধ।
হামাস কর্র্তৃপক্ষ রবিবার থেকে অন্তত ৬৭ জনের প্রাণহানির খবর জানিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতেও কেউ কেউ রমজানের শুরুটা উদযাপনের জন্য সামান্য সাজসজ্জা করেছেন এবং তাঁবুর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী ফানুস বিতরণ করেছেন।
মসজিদ নেই
সিএনএন জানাচ্ছে, গাজায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ পুরো আশপাশের এলাকাগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, চিকিৎসা ব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং শত শত মসজিদ ধ্বংস করেছে, ধর্মীয় স্থানগুলো ধ্বংসাবশেষে পরিণত করেছে। ১২০০ মসজিদের মধ্যে অন্তত ১০০০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় সিএনএনকে জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ধর্মীয় নেতা, ইমাম, মুয়াজ্জিন এবং হাফেজসহ ১০০ জনেরও বেশি প্রচারককে হত্যা করা হয়েছে।
সিএনএনকে গাজাবাসী জানান, তারা রাতে তারাবিহর নামাজে অংশ নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। কারণ মসজিদগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। রমজানের প্রতি রাতে তারাবিহর নামাজ জামাতে আদায় করা হয়। পানি কম থাকায় সবাই নামাজের আগে বাধ্যতামূলক হওয়ার পরও ওজু করতে পারে না।
ওয়াশিংটন পোস্ট রমজান শুরুর পর পাঁচজন গাজাবাসীর সঙ্গে কথা বলে। কীভাবে তারা রমজান পালন করছেন সংবাদ সংস্থাটি জানতে চায়। সেখানে এক মসজিদের খতিব বলেছেন, তিনি প্রধানত পাতাযুক্ত সবুজ গাছপালা খেয়ে বেঁচে আছেন। এসব গাছ শীতের আগের বৃষ্টিতে বৃদ্ধি পায় এবং বসন্ত আসার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। খতিব বলেন, আমরা কখনো আশা করিনি, আজ পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। আল্লাহর ইচ্ছা রমজানের আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে।
ধ্বংসযজ্ঞে জীবন
পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার প্রথম সপ্তাহে গাজাবাসীর আশা ছিল, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে। বন্দি জিম্মিদের বিনিময়ে ফিলিস্তিনি মুক্ত করার সুযোগ মিলবে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল আনসারি যা বলেছেন তাতে যুদ্ধবিরতির আশা ক্ষীণ। মুসা নামে একজন বলেন, রমজানে সাধারণত আমরা প্রচুর রাতের খাবারের আমন্ত্রণ পেতাম। এখন পরিবারের প্রত্যেক সদস্য আলাদা জায়গায় রয়েছে। শেষ কবে আমি ইসরায়েলি ড্রোনের শব্দ ছাড়াই আজান শুনেছি মনে নেই।
এর ভেতরও গাজার মুসলমানরা সিএনএনকে বলেছে তারা প্রচণ্ড ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে স্বস্তির মুহূর্তগুলো খুঁজে বের করার জন্য প্রতিদিনের আচার-অনুষ্ঠান করতে বদ্ধপরিকর। রাফাহ’র স্বাস্থ্যকর্মী হামুদা বলে, আমরা ধ্বংস হওয়া মসজিদগুলোর পাশে নামাজ পড়ছি। আমরা যখন বাস্তুচ্যুত লোকদের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে খনন করে বের করি তখন বলি ‘আল্লাহু আকবর। এগুলো আমাদের বিশ্বাসের মূল বিষয়; প্রার্থনা, এবং অন্যদের সাহায্য করা, এবং আমাদের সেরাটা করা।
এনবিসি নিউজ তাদের প্রতিবেদনে জানায়, রমজানে হুসেন আওদা এবং তার পরিবারের সাত সদস্য সেহরির জন্য বসেছিলেন। তাদের সামনের টেবিলে ছিল মাত্র ৭ আউন্স দই, পনির এবং কিছু রুটি। আওদা বলেন, আমরা এ খাবারও পুরো শেষ করিনি। কারণ আমরা অল্প পরিমাণে খাবার খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। ওউদা বলেন, তাকে এবং তার পরিবারকে বাধ্য করা হয়েছে গত প্রায় ছয় মাস রোজা রাখতে। কারণ অন্য সময়ও তারা না খেয়েই ছিলেন, তবে এখন যেহেতু রমজান শুরু হয়েছে, পার্থক্য শুধু সময়সূচিতে। দক্ষিণ গাজার রাফাহে বাস্তুচ্যুত হওয়া কম্পিউটার প্রকৌশলী বলেন, ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের হামলা শুরু হওয়ার পর তিনি প্রায় ৬৫ পাউন্ড ওজন হারিয়েছেন।
খাবার প্রবেশে ইসরায়েলি বাধা
নিউ ইয়র্ক টাইমস গাজার একটি সড়কের বিবরণ দিতে গিয়ে জানায়, এ রমজানে রাস্তাটি ভয়ংকর। এখানে কোনো বিদ্যুৎ নেই এবং রাস্তাটি ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত ভবন দ্বারা পূর্ণ। এক ব্যক্তি তাদের বলেন, এখানে রমজানের কোনো মর্যাদা নেই। আমরা আমাদের পরিবার এবং জমায়েত, খাবার, এমনকি মিষ্টি, সাজসজ্জার মতো সহজ জিনিসগুলোকে মিস করছি।
মানবাধিকার গোষ্ঠী, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এবং সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান বলেছেন, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের ক্ষুধার্ত রাখছে। ইসরায়েল পুরো যুদ্ধ জুড়ে বলেছিল যে তারা গাজায় যতটা সম্ভব সাহায্যের অনুমতি দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখন তারা জাতিসংঘের কর্মী ও খাদ্য সরবরাহে বিলম্ব ঘটাচ্ছে। আর জাতিসংঘের কর্মকর্তারা যুক্তি দিয়েছেন, ইসরায়েল খাদ্যপণ্যবাহী ট্রাক আটকে রেখেছে। তারা সেগুলোর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা সহজ করছে না।
ফিলিস্তিনিদের এ দুর্দশা লাঘবে মুসলিম বিশ্বের যথাযথ ভূমিকা প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেকে। এক দিকে যখন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ পবিত্র রমজান মাস পালনে ব্যস্ত, ফিলিস্তিনে তখন চলছে হাহাকার, মানবেতর জীবন। এ অবস্থা থেকে তাদের উদ্ধারে মুসলিম নেতাদের ভূমিকার দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। তবে কোনো ব্যবস্থাই যে শেষ পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে না তা নিয়ে হতাশা আর ক্ষোভ বাড়ছে মুসলিম বিশ্বে। অন্যান্য বিশ্বাস ও ধর্মের মানুষও ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধে কর্মসূচি পালন করেছে। তবে রমজান আসার আগে থেকে যেন সব স্তিমিত। পবিত্র রমজানে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের চালানো বিভীষিকাকে আরও উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
বোমার আঘাতে প্রাণহানির সঙ্গে দুর্ভিক্ষ যোগ হয়েছে সেখানে। না খেয়ে অন্তত ২৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ পরিস্থিতি আরও করুণ হবে। যুদ্ধের কোনো আইন ইসরায়েল মানছে না। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারছে না কোনো বিশ্বশক্তি।
ভয়েস/আআ