শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:২৩ অপরাহ্ন
মো. আবদুর রহমান:
ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় নামাজ বলা হয় নির্ধারিত কথা ও কাজ বিশিষ্ট এমন এক ইবাদতকে, যা তাকবিরে তাহরিমার মাধ্যমে শুরু হয় এবং সালাম ফেরানোর মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে। নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। মহান আল্লাহর কাছে বান্দার আনুগত্য প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে নামাজ।
নামাজে একাকী হোক আর জামাতবদ্ধভাবে হোক বান্দাকে এক কেবলার দিকেই মুখ ফেরাতে হয়। একই সময়ে নির্দিষ্ট নামাজ আদায়ের জন্য একই ইমামের পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হয়। এভাবে নামাজ আদায়ের ফলে মুমিনের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ গড়ে ওঠে। শৃঙ্খলার এই শিক্ষা নামাজ থেকেই পাওয়া যায়। এছাড়া নামাজ আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা কারণে মানসিক চাপ তৈরি হয়। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আমাদের মানসিক চাপ পুরোপুরি হ্রাস করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিংহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল নামাজ নিয়ে গবেষণা করেছেন। দীর্ঘ গবেষণার পর গবেষকরা দাবি করেছেন, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় আমাদের শরীর ও মন প্রফুল্ল রাখে। নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মানুষ শারীরিকভাবে উপকৃত হয়। নামাজ শরীর সুস্থ থাকার একটি টনিক। যারা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন সাধারণত তারা শারীরিক অনেক সমস্যা থেকে মুক্ত থাকেন এবং তাদের শরীরে সহজে রোগ-ব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে না। এটি পৃথিবী সৃষ্টি থেকে আজ অবধি প্রমাণিত। বস্ততপক্ষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নির্ধারিত সময় ও রাকাত সংখ্যাসহ মানুষের আত্মার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য ও স্বাস্থ্য রক্ষাকারী ইনজেকশন-স্বরূপ। আর স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন এ ব্যবস্থাপত্র; যিনি মহাজ্ঞানী এবং অনন্ত প্রজ্ঞার অধিকারী।
নামাজে যখন সেজদা করা হয় তখন আমাদের মস্তিষ্কে দ্রুত রক্ত প্রবাহিত হয়। যার ফলে স্মৃতিশক্তি অনেক বৃদ্ধি পায়। নামাজে যখন দাঁড়ানো হয় তখন জায়নামাজের সামনের দিকের একটি নির্দিষ্ট স্থানে চোখ স্থির থাকে ফলে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। নামাজের মাধ্যমে শরীরের একটি ব্যায়াম সাধিত হয়। এই সময়ে দেহের সব অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিভিন্নভাবে বারবার নড়াচড়া করে। যা একটি উত্তম ব্যায়াম হিসেবে স্বীকৃত। নামাজ আদায় করতে হলে দৈনিক পাঁচবার ওজু করতে হয়, যা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় অঙ্গকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে সহায়তা করে। এটি নাক, মুখ, চোখ, দাঁত ও পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার রাখার অতুলনীয় কৌশলও বটে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার এ শিক্ষা নামাজ থেকে পাওয়া যায়। নিয়মিত নামাজ আদায় করলে মানুষের জীবনীশক্তি বৃদ্ধি পায়। কেবলমাত্র নামাজের মাধ্যমেই চোখের নিয়মমাফিক যত্ন নেওয়া সম্ভব হয়। যার কারণে অধিকাংশ নামাজ আদায়কারী মানুষের দৃষ্টিশক্তি তীক্ষ্ম থাকে। নামাজ মানুষের বোধশক্তিকে জাগ্রত করে পাপাচার থেকে বাঁচিয়ে রেখে ভালো মানুষ হতে সাহায্য করে। নামাজের মাধ্যমে বান্দার রুহ তাজা হয়। এর মাধ্যমে বান্দা গুনাহমুক্ত হয়। নামাজের প্রতিটি সেজদায় বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। উবাদাহ ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, ‘যখন কোনো বান্দা মহান আল্লাহর জন্য একটি সেজদা করে, মহান আল্লাহ এর বিনিময়ে তাকে একটি নেকি দান করেন, তার একটি গুনাহ মাফ করেন এবং তার মর্যাদা এক ধাপ উন্নত করেন। অতএব তোমরা অধিক সংখ্যায় সেজদা করো। (ইবনে মাজাহ)
নামাজ এমন ইবাদত, যা শুধু নিজে আদায় করলেই হয় না; বরং অধীনস্তদেরও আদায় করাতে হয়। নিজে নামাজ আদায় করা যেমন ফরজ, তেমনি পরিবার-পরিজনকে নামাজের আদেশ দেওয়াও ফরজ। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘আপনি আপনার পরিবারের লোকদের নামাজের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন।’ (সুরা তাহা ১৩২) আর হজরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীর সব অভিভাবকের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের ৭ বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও এবং ১০ বছর বয়সে তাদের নামাজে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য কঠোর শাসন করো।’ (আবু দাউদ ৪৯৫) নামাজ আদায়ের দায়িত্ব থেকে কেউ রেহাই পায় না। নামাজের সময় হলে সব মুমিন ব্যক্তি নামাজ আদায় করতে বাধ্য।
নামাজ মুসলমান হওয়ার পরিচয় বহন করে। পক্ষান্তরে নামাজ বর্জন কাফেরদের সাদৃশ্য তুলে ধরে। আজান দেওয়ার পর কোনো কাফের নামাজ আদায় করতে যায় না। তাই নামাজের সময় কোনো মুসলমানও যদি নামাজ আদায় না করে কিংবা মসজিদে না যায়, তাহলে কাফেরদের সঙ্গে তার এক ধরনের সাদৃশ্য সৃষ্টি হয়। এ কারণেই হাদিস শরিফে নামাজ বর্জনকে কুফরিতুল্য পাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমাদের ও কাফেরদের মধ্যে মুক্তির যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তা হলো নামাজ। সুতরাং যে ব্যক্তি নামাজ ছেড়ে দেয়, সে কুফরি কাজ করে। (জামে তিরমিজি)
নামাজ ত্যাগ করার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ ও কঠিন। যারা বিনা ওজরে নামাজ ত্যাগ করবে তাদের জন্য রয়েছে নিদারুণ নরকের যন্ত্রণা। এ ছাড়া নামাজের ব্যাপারে যারা উদাসীন থাকে তাদের ব্যাপারে শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘অতএব দুর্ভোগ সেই সব নামাজ আদায়কারীদের জন্য যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে।’ (সুরা মাউন ৪-৬) অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘(সেদিন) অপরাধীদের সম্পর্কে পরস্পরে জিজ্ঞেস করবে, তোমাদের কীসে জাহান্নামে ঠেলে দিয়েছে? তারা বলবে, আমরা নামাজি ছিলাম না।’ (সুরা মুদ্দাসসির ৪১-৪৩) এ আয়াত দ্বারা প্রমাণ হয় যারা নামাজ আদায় করবে না, তারা জাহান্নামে যাবে।
কেয়ামতের দিন নামাজের মাধ্যমেই মানুষের হিসাব-নিকাশ শুরু হবে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম মানুষের নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। যদি তার নামাজ গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে সমস্ত আমল গ্রহণীয় হবে। আর যদি নামাজ গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে সমস্ত আমলই বাতিল হবে।’ (সিলসিলায়ে সহিহা)
নামাজ ত্যাগকারী ব্যক্তি ইসলামি জীবন থেকে বঞ্চিত এবং তার জীবনযাপন কাফেরের জীবনযাপনের মতোই। কেননা হাদিসের একাধিক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে নামাজ। মুসলিম ব্যক্তি নামাজ আদায় করে আর অমুসলিম ব্যক্তি নামাজ আদায় করে না। হজরত উবাদা ইবনে সামির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুল (সা.) আমাদের সাতটি অসিয়ত করেন, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ হলো, ‘তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না। যদি তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় বা অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয় তাহলেও ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ত্যাগ কোরো না। কেননা, যে ইচ্ছা করে নামাজ ছেড়ে দেয় সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়।’
কাজেই পরকালে নাজাত পেতে হলে দুনিয়ার জীবনে নামাজের প্রতি যতœবান হতে হবে। নামাজি ব্যক্তিরাই জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা হবেন। তাই নামাজ আদায়ের প্রতি দৃঢ় হতে হবে এবং একমাত্র মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য নামাজ পালনে ব্রতী হতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের তওফিক দান করুন।
ভয়েস/আআ