শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪৩ অপরাহ্ন
শাহাদাত গাজী:
বিদআত আরবি শব্দ। আরব বিশ্ব ছাড়াও পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মুসলিম অধ্যুষিত দেশে এটি বহুল পরিচিত একটি শব্দ। বিদআত বলা হয় দ্বীন ও ইবাদতে নবআবিষ্কৃত কাজকে। অর্থাৎ দ্বীন বা ইবাদত ভেবে করা এমন কাজকে বিদআত বলা হয়, কোরআন ও হাদিসে যে কাজের কোনো দলিল নেই।
বিদআতের শাব্দিক ব্যাখ্যা : বিদআত শব্দের শাব্দিক ব্যাখ্যায় মুসলিম মনীষী ইমাম রাগেব বলেন, ‘কোনোরূপ পূর্ব নমুনা না দেখে এবং অন্য কিছুর অনুকরণ-অনুসরণ না করে কোনো কর্ম নতুনভাবে সৃষ্টি করাই হলো বিদআত।’ আর দ্বীনের ক্ষেত্রে বিদআত হলো, ‘শরিয়ত প্রবর্তক যে কথা বলেননি সে কথা বলা এবং তিনি যা করেননি সেটাকে আদর্শরূপে গ্রহণ করা।’
মোল্লা আলি কারি মিরকাত গ্রন্থে বিদআত প্রসঙ্গে বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর যুগে ছিল না এমন নীতি ও পথকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রবর্তন করাই বিদআত।’ এই দুটি ব্যাখ্যা সামনে রাখলে এটা স্পষ্ট হয় যে, বিদআত হলো দ্বীন ইসলামের অভ্যন্তরে এমন সব কর্মপন্থা চালু করা; যার সপক্ষে ও সমর্থনে শরিয়তের কোনো দলিল নেই।
হাদিসের ভাষায় বিদআত : হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার এই শরিয়তে নতুন কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করবে তা পরিত্যাজ্য। (সহিহ মুসলিম)
ইসলামি শরিয়তের মূল দাবি হলো, ইবাদত-বন্দেগির কাজ তথা যা করলে সাওয়াব হবে এবং যা না করলে গুনাহ হবে এমন কাজ অবশ্যই হতে হবে মহান আল্লাহর সন্তোষজনক পন্থায় এবং রাসুল (সা.)-এর প্রদর্শিত পদ্ধতিতে। এছাড়া অন্য যেকোনো পথ-পদ্ধতি যত সুন্দর, সহজ ও আকর্ষণীয় হোক না কেন তা অগ্রহণযোগ্য।
বিদআত যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় : সুন্নত ও বিদআত গ্রন্থে বিদআত উদ্ভূত হওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এক. কোনো বিদআতি নিজ থেকে কোনো বিদআত চালিয়ে দেয়, যা একটা সময় সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দুই. কোনো আলেম জানা সত্ত্বেও নিজের কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য কোনো বিদআত করেছেন, কিন্তু মূর্খ সমাজের লোকেরা ভাবল, অমুক আলেম যেহেতু করছেন অবশ্যই তা শরিয়ত সমর্থিত। এক কথায় অন্ধ অনুসরণ। তিন. জাহেল লোকেরা কোনো বিদআত কিংবা শরিয়তবিরোধী কোনো কাজ করার পর ওই সমাজের আলেমরা যখন তা প্রতিহত না করে নীরব থাকেন তখন জাহেলরা মনে করে এটাও তাহলে শরিয়তের অংশ। শরিয়তবিরোধী হলে তো আলেমরা বিরোধিতা করতেন।
সমাজে প্রচলিত একটি বিদআত : আমাদের সমাজে অতি প্রচলিত একটি বিদআত হলো রাসুল (সা.)-এর শানে মিলাদ পাঠ। যুগ যুগ ধরে এই উপমহাদেশের মানুষ ভক্তি, বিশ্বাস ও আবেগের সঙ্গে এটি পালন করে আসছে। সত্য বলতে এ অঞ্চলের মুসলমানরা অতি আবেগি। কোনো একটি কর্ম আমলের নিয়তে শত শত বছর করে এলেও কখনো দলিল-প্রমাণের তুলাদণ্ডে পরখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না যে, আসলে এ কাজটা কতটুকু শরিয়ত সমর্থিত। অনেক আলেম মানুষের মধ্যে সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করলেও তারা বিদআত আধিক্যতাপূর্ণ সমাজে সহজে সফল হতে পারছেন না। মিলাদ রাসুল (সা.)-এর জামানায় ছিল না। ছিল না তার সত্যানুসারী সাহাবি, তাবেয়ি কিংবা তাবে তাবেয়িদের সময়ে।
মিলাদের ইতিহাস : মিলাদের ইতিহাস সম্পর্কে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আহমদ শারবাকি লিখেছেন, ‘রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর প্রায় দুইশো বছর পর ফাতেমীয় শাসকরা এটার আবিষ্কার করেন।’ কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, ৬০৪ হিজরি সনে ইরাকের মসুল শহরের বাদশাহ আবু সাইদ মুজাফফর উদ্দিন কাওকারি এবং আবুল খাত্তাব ওমর ইবন দিহইয়ার মাধ্যমে সর্বপ্রথম প্রচলিত পদ্ধতির মিলাদ মাহফিলের সূচনা হয়।
মিলাদ ও দরুদ ভিন্ন বিষয় : মিলাদ ও দরুদ দুটি আলাদা বিষয়। যদিও বিদআতি সমাজে অনেক সময় মিলাদকে দরুদ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। তা সঠিক নয়। মিলাদ হলো রাসুল (সা.)-এর জন্মবৃত্তান্তমূলক বিভিন্ন শের ও ছড়া, যা কয়েকজন একত্র হয়ে পড়ে। আর দরুদ হলো রাসুল (সা.)-এর সম্মান ও মর্যাদার জন্য শরিয়ত সমর্থিত বাক্য দ্বারা দোয়া করা। দরুদ পাঠ একটি ইবাদত। নামাজে এবং রাসুল (সা.)-এর নাম শ্রবণ করার পর দরুদ পাঠ ওয়াজিব। দরুদ পাঠের বিষয়ে আল্লাহতায়ালা নির্দেশ প্রদান করেছেন, কিন্তু মিলাদের জন্য আল্লাহর কোনো নির্দেশনা নেই। দরুদ পাঠকারীর জন্য রাসুল (সা.) অনেক ফজিলত বর্ণনা করেছেন। পক্ষান্তরে মিলাদের ব্যাপারে এসব নেই।
বিদআতের পরিণাম : ইসলামি শরিয়তে বিদআতের কোনো স্থান নেই। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধগুলোর একটি হলো দ্বীনি বিষয়ে বিদআত। বিদআতকারীদের ভাবনাটাই যেন এমন যে, মুহাম্মদ (সা.) কর্র্তৃক রেখে যাওয়া শরিয়ত তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই তারা নতুন কিছু আবিষ্কার করছে। অথচ দ্বীনের পূর্ণতা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে।’ (সুরা মায়েদা ৩) সুতরাং ইসলামি শরিয়তকে অপূর্ণ মনে করা কিংবা অধিক সাওয়াবের আশায় নতুন কর্ম চালু করার অর্থই হলো পূর্ণাঙ্গ দ্বীনকে অস্বীকার করা। দ্বীনের ক্ষেত্রে বিদআতের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক বিদআত ভ্রষ্টতা, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (সহিহ মুসলিম)
ভয়েস/আআ