শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:১৪ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

আর নয় গলার কাঁটা রোহিঙ্গা

মোস্তফা হোসেইন:

বাংলাদেশের বিষফোঁড়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না আজও। প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জের টানতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। মিয়ানমার থেকে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফেরৎ যাওয়া উচিত, এটুকু মিয়ানমার স্বীকার করলেও তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই তারা নিচ্ছে না। বরং কয়েকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়নি।

এদিকে দেশটিতে সংঘাতময় পরিস্থিতির অবনতি চলছেই। সম্প্রতি ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছে। এরইমধ্যে আরও অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার সীমান্তে খোলা আকাশের নিচে দিনযাপন করছে। তারা বাস্তুচ্যুত হয়েছে জান্তা বাহিনীর অত্যাচারে। বাস্তুচ্যুত এই ১০ হাজার রোহিঙ্গাকেও যেন বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হয় অনুরোধ জানিয়েছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। কারণটা মানবিক। সত্যি মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের শিকার সংখ্যালঘু এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।

২০১৭ সালে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর বাংলাদেশ শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। যা এখনও বহাল আছে। বাংলাদেশ বারবারই বলছে, মিয়ানমারের দায় বাংলাদেশ বহন করবে কেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চাপ দিয়ে চলেছে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের যেন মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া হয়। বাংলাদেশের অস্বীকৃতির পরও দীর্ঘ সীমান্ত পথে রোহিঙ্গারা রাতের অন্ধকারে সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। যেহেতু বাংলাদেশ আর কোনো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেবে না আগে থেকেই বলে আসছে, সেই কারণে নতুন আসা এই বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোর নিবন্ধনও হয়নি। নিবন্ধন করা হবে না বলেও বাংলাদেশ পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বিশাল সংখ্যক এই রোহিঙ্গাদের এখন মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

মিয়ানমারের এই মানবাধিকার লংঘনকে চিকন গলায়-মোটা গলায় সবাই নিন্দা জানাচ্ছে। মিয়ানমারকেও বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সতর্কও করা হচ্ছে। তবে তাদের সতর্কতাকে সামান্যই পাত্তা দিচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার সময় এবং সেখানে বিভিন্ন সংস্থার নেতাদের সংগে আলোচনাকালে দৃঢ়কণ্ঠে রোহিঙ্গা সমস্যার কথা তোলে ধরেছেন। আগের মতোই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা এই সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন। গতানুগতিকভাবে বাংলাদেশের ভূমিকাকেও তারা প্রশংসা করেছেন। মিয়ানমার সরকার যেন মানবিক আচরণ করে সেই আহ্বানও তারা আগের মতোই উচ্চারণ করেছেন। সেই আগের মতোই তারা বলছেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে যেন বাংলাদেশ মানবতার উদাহরণকে শক্তিশালী করে।

বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। যেমনি আগেও ১০ লক্ষাধিককে আশ্রয় দিয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন জন্মদানে অভ্যস্ত এই রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে ২০ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের বাসস্থানের জন্য বাংলাদেশকে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। আর্থসামাজিক অবস্থার অবনতি, জননিরাপত্তাহীনতার মতো গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করেছে এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।

যারা রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক হওয়ার আবেদন জানিয়ে বাংলাদেশকে বার বার অনুরোধ করছে, তারা মিয়ানমারকে নৃশংসতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে পারছে না। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা চাপিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের ওপর। বাংলাদেশকে মানবিক দিক থেকে দেখার অনুরোধ করার চেয়ে তারা যদি মিয়ানমারকে গণহত্যা বন্ধে রাজি করাতে পারতো তাহলেই রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু তারা মিয়ানমারকে মানবিক হতে বাধ্য করতে না পেরে সাময়িক সমাধান হিসেবে বাংলাদেশকেই অনুরোধ করছে। এটা সাময়িক উপশম মনে হলেও বাংলাদেশের জন্য এই অবস্থা আর মেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

এই মুহূর্তে নতুন সরকার বাংলাদেশে শাসন চালানোর দায়িত্ব নিয়েছে। বিষয়টি নতুন সরকারের জন্যও চ্যালেঞ্জের বলে মনে করতে হবে। তবে আশার কথা প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস এর ব্যক্তিগত ইমেজ কাজে লাগিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবেন। আর সেটা সম্ভব হলে হয়তো এই দুষ্টগ্রহ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি হতেও পারে।

অনেকের ধারণা মিয়ানমারে জান্তা সরকারের ক্রীড়নক শক্তি হিসেবে চীনের অবস্থানই এর মূল কারণ। চীন কি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো শক্তি? সারা বিশ্বের মানবতাবাদী শক্তি এক হলে চীন কি তাদের বাধা দিয়ে টিকে থাকতে পারবে? এমন প্রশ্নটা আমার মতো লে-ম্যান করতেই পারে। কূটনীতির মারপ্যাঁচ আমার মাতো সাধারণ মানুষের বোঝার শক্তি নেই, কিন্তু এটুকু বুঝি এই বাড়তি জনশক্তি আমাদের দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ।

দেখতে পাই, যেসব মুসলমান অধ্যুষিত দেশ রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য মায়াকান্না জুড়ে দিয়েছিলো, তারা আজকে অদৃশ্য। তাইলে তাদের এই মায়াকান্না কি বাংলাদেশের ঘাড়ে বোঝা বাড়িয়ে দেওয়াই ছিলো মূল? ওআইসিসহ মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো আশ্রিত মানুষগুলোর সহযোগিতা করতে পারলেও রোহিঙ্গা স্রোত ঠেকানোর মতো শক্তি তাদের নেই। কারণ মিয়ানমার তাদের কথা শুনবে এমন সম্ভাবনা নেই।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারে গণহত্যা বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের হত্যা তাদের বাস্তুচ্যুত করে দেওয়া ঘটনায় মামলা চলমান। কিন্তু নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না সেই আদালতের রায় আদৌ বাস্তবায়ন করা যাবে কিনা। কিংবা কতদিনে সেই মামলার সমাপ্তি ঘটবে তাও কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারছে না।

বাংলাদেশের গলারকাঁটা এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অর্থনীতি, সামাজিক ও নিরাপত্তাক্ষেত্রেও হুমকির সৃষ্টি করছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত জনশক্তি রফতানিতেও তারা ভাগ বসিয়েছে। সম্পূর্ণ অবৈধভাবে তারা বাংলাদেশে জন্মসনদ, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, এনআইডি গ্রহণ ও পাসপোর্ট করিয়ে নিতে পারছে। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে তারা বিভিন্ন দেশে বসতিও করছে। আবার সরকারিভাবেও কিছু রোহিঙ্গাকে পাঠানো হয়েছে। যেমন ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছে আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে। এটা সরকারিভাবেই দেওয়া হয়েছে। সৌদি আরবের হিসাবে এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত।

শুধু তাই নয় সাম্প্রতিক সময়ে এই রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে ৩ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করে জন্মসনদ, ভোটার তালিকায় নাম তোলা এমনকি পাসপোর্টও বানিয়ে নিচ্ছে। দালালদের সহযোগিতায় তারা বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব রোহিঙ্গা হানাহানির মতো ঘটনা ঘটিয়ে বাংলাদেশিদের বদনাম করছে। যা বাংলাদেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে।

এই রোহিঙ্গারা যে বাংলাদেশের জন্য কতটা বিপজ্জনক তা সৌদি আরবে তাদের অবস্থান দেখে অনুমান করা যায়। তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে এখন সেখানে অবস্থান করছে। তাদের পাসপোর্ট রিনিউ করার বিষয়ে বাংলাদেশ সম্মতি জানিয়েছে। কোনো কারণে যদি সৌদি আরব তাদের রাখতে না চায় তখন পাসপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশকেই তাদের গ্রহণ করতে হবে। তার মানে, বাংলাদেশে এখন যে ১৫/২০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে এটাই শেষ নয়, মিয়ানমার থেকে নতুন করে বাংলাদেশে না এলেও তিন লাখের মতো অতিরিক্ত রোহিঙ্গা কাগজে কলমে বাংলাদেশে প্রবেশের দাবিদার।

এই মুহূর্তে নতুন সরকার বাংলাদেশে শাসন চালানোর দায়িত্ব নিয়েছে। বিষয়টি নতুন সরকারের জন্যও চ্যালেঞ্জের বলে মনে করতে হবে। তবে আশার কথা প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস এর ব্যক্তিগত ইমেজ কাজে লাগিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবেন। আর সেটা সম্ভব হলে হয়তো এই দুষ্টগ্রহ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি হতেও পারে।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

ভয়েস/আআ/সূত্র: জাগো নিউজ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION