শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৩২ অপরাহ্ন
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ:
আজ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য : বিশ্বব্যাপী প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ প্রতি বছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রবীণদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে এ দিবসটি পালন শুরু হয়। জাতিসংঘ এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নাগরিকদের জন্য ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব এবং উন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ৬৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীদের প্রবীণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মানুষের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা দিন দিন কমতে থাকে, যার ফলে প্রবীণ ব্যক্তিদের বেলায় বেশ কিছু অসুস্থতা প্রায় সবার মধ্যে দেখা দিয়ে থাকে। আর শুধু শারীরিক রোগ-ব্যাধিই নয়, প্রবীণদের সমস্যাটা আসলে বহুমাত্রিক। তারা মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবেও সমস্যায় জর্জরিত। আসলে একটা মানুষ যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তার নিজের মধ্যেই কিছু কিছু জিনিস দানা বেঁধে ওঠে, যেমন শারীরিক অসামর্থ্য, অসহায়ত্ব, পরনির্ভরশীলতা এবং অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা। এসব কারণে মানসিক যন্ত্রণা থেকে শুরু করে নিজেকে অবাঞ্ছিত, পরিবারের বা সমাজের বোঝা মনে করেন। অনেক প্রবীণই বিষন্নতায় ভোগেন। অনেক সময় এমন অযৌক্তিক ও শিশুসুলভ আচরণ তাদের মধ্যে প্রকাশ পায়, যাকে অনেকেই দ্বিতীয় শৈশব বলে মনে করেন। প্রবীণদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
প্রবীণদের প্রতি সম্মান দেখানো সব সমাজেরই অনুসরণীয় রীতি। আগেকার সমাজে বৃদ্ধরা বেশ সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় ছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বৃদ্ধদের ওপর এই শ্রদ্ধা ও সম্মান অক্ষুন্ন ছিল। বিশেষ করে প্রাচ্য সমাজে বৃদ্ধদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শনের ঐতিহ্য আজও মোটামুটি লক্ষ করা যায়। তারপরও কিছু কিছু বৃদ্ধদের মায়া-মমতায় ঘেরা পরিবারের বাইরে অবস্থান করতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ইসলাম বৃদ্ধদের অসম্ভব শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়েছে। হজরত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বয়োবৃদ্ধের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করবে, মহান আল্লাহ তাকে কেয়ামতের দিন সব ভয়-ভীতি ও আশঙ্কা থেকে নিরাপদে রাখবেন।’
বৃদ্ধদের শ্রদ্ধা-সম্মান করা আর ছোটদের স্নেহ করা ইসলামি নৈতিকতার অন্যতম বিধান। যারা ইসলামের এই বিধান মেনে চলবে না, তারা অবশ্যই আল্লাহর সামনে অপরাধী হিসেবে উপস্থিত হবে। বস্তুত ‘জ্ঞানীকে তার জ্ঞানের জন্য আর বৃদ্ধকে তার বয়সের জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হবে।’ এটাই ইসলামের শিক্ষা। হজরত রাসুল (সা.) প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রবীণ ও নবীন মিলেই এ দুনিয়ার সমাজ ব্যবস্থা। যারা দুনিয়াতে আগে এসেছেন তারা পরবর্তীদের কাছে শ্রদ্ধাভাজন এবং প্রবীণ হিসেবে মর্যাদার অধিকারী। আর নবীনরা প্রবীণদের কাছে স্নেহভাজন এবং তাদের আদর-সোহাগ পাওয়ার অধিকারী। প্রবীণদের শ্রদ্ধা করা এবং নবীনদের স্নেহ করা হজরত রাসুল (সা.)-এর সুন্নত। হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ সম্পর্কে বলেন, ‘যারা ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না তারা আমার দলের অন্তর্ভুক্ত নয়।’
আসলে মর্যাদাবান ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া উচিত। এটা মহানবীর শিক্ষা। এক হাদিসে হজরত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষের সঙ্গে তাদের মর্যাদা অনুযায়ী আচরণ করো।’ (আবু দাউদ) এ কথা ঠিক, ধনী-গরিব, সৎ-অসৎ, ছোট-বড় সবাই আইনের দৃষ্টিতে সমান। আল্লাহর নির্ধারিত আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের কারও প্রতি সামান্যতম পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না। কিন্তু সামাজিক আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে জ্ঞান-গরিমা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাকওয়া-পরহেজগারি ও অন্যান্য বিশেষ পদমর্যাদার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। এ কথাকেই ‘মর্যাদা অনুযায়ী আচরণ করো’ বাক্যে বর্ণনা করা হয়েছে।
ইসলামের শিক্ষা হলো, সন্তানের অসহায়ত্বের সময় যেভাবে মা-বাবা তাকে স্নেহভরে সযতেœ প্রতিপালন করেন। মা-বাবার অসহায়ত্ব তথা বৃদ্ধাবস্থায় তাদেরও সেভাবে লালন-পালন করা সন্তানের অবশ্য কর্তব্য। এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা অমানবিক ও ইসলাম বিবর্জিত কাজ। এমন কাজ যারা করে তাদের কোনো ক্ষমা নেই। এ অবহেলার জন্য সন্তানদের পরকালে কঠিন শাস্তি জাহান্নামের আগুনে জ¦লতে হবে আর দুনিয়াতেও তাদের বার্ধক্য অবস্থায় আরও চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে। বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে এবং মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের ওহ শব্দও বলো না এবং তাদের ধমক দিও না; তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো।’ এভাবেই ইসলাম মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন ও সর্বস্তরের প্রবীণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তাদের অসহায়ত্বের সময় সেবাযত্ন করার তাগিদ দিয়েছে। ইসলামের এ নির্দেশনা মেনে চললে প্রবীণ নিবাসে বেদনাদায়কভাবে প্রবীণদের জীবনযাপন করার প্রয়োজন হতো না। একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ তার বৃদ্ধা মা-বাবাকে এবং তার আত্মীয়স্বজনকে অবহেলা ও উপেক্ষা করতে পারে না।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইসলামের শিক্ষাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। বিশেষ করে প্রত্যেক বৃদ্ধের ছেলে মেয়েদেরই এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মুসলমানদের উচিত নিজেদের ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রবীণদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা এবং এর মাধ্যমে নিজেদের দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তির ব্যবস্থা করা। আল্লাহতায়ালা সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে প্রবীণদের প্রতি যত্ন নেওয়ার তওফিক দান করুন। আমিন।
ভয়েস/আআ