শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ০২:২৪ অপরাহ্ন
মুফতি ইবরাহীম আল খলীল:
৪০ বছর বয়সে হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াত লাভ করেন। সর্বপ্রথম তার প্রতি ওহি নাজিলের সময় জিবরাইল (আ.) তিন বার তাকে বুকে জড়িয়ে চাপ দেন। এরপর ওহির বাণী শোনান, ‘পড়ুন আপনার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ এভাবে সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত পড়ে শোনান। এরপর নবীজি কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরেন। পুরো ঘটনা খুলে বলেন প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.)-কে। তখন তিনি যে কথাগুলো বলে নবীজিকে সান্ত¡না দিয়েছিলেন তা ছিল ‘কক্ষনো নয়! আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে কখনো বিব্রত করবেন না। কেননা আপনি আত্মীয়তা রক্ষা করেন, দুস্থের ভার বহন করেন, নিঃস্বের জন্য উপার্জন করেন, মেহমানের সমাদর করেন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে (মানুষের) সহযোগিতা করেন।’ (সহিহ বুখারি ৩)
এমনই ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহম্মদ (সা.)। এমনই ছিল তার আদর্শ। দুস্থের ভার গ্রহণ, অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো এবং দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা তার মহান সুন্নত। আমাদের চারপাশে বহু মানুষ প্রায়ই অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটায়। এমন লোকের সংখ্যা কম নয়, যারা অভাবের কথা প্রকাশও করতে পারেন না। বিশেষভাবে বর্তমানে বন্যার এই পরিস্থিতিতে। যখন হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি। অনেকেই ঘরবাড়ি হারা। কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। এমন মুহূর্তে আমাদের কর্তব্য হলো রাসুল (সা.)-এর এই মহান আদর্শের ব্যাপক চর্চা করা।
টানা বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢলের কারণে শেরপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার কয়েকটি অঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বেশ কিছু এলাকার বন্যা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক আকার ধারণ করছে ক্রমাগত। পানিবন্দি হাজারো মানুষ। অনেকের ঘরে পানি। আশ্রয়কেন্দ্রে পাড়ি জমিয়েছেন বহু মানুষ। শত শত একর ফসলের জমি তলিয়ে গেছে। হুহু করে মুহূর্তেই চতুর্দিকে বাড়ছে পানি।
উত্তরবঙ্গেও বন্যা দেখা দিয়েছে। অতিবর্ষণ ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রবল স্রোতে রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নদীগুলোয় দেখা দিয়েছে ভাঙন। মানুষজন ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উঁচু স্থান ও বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছে। ওই অঞ্চলে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা যাচ্ছে এই অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়ে। কৃষিতে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের মানুষের কৃষিজমির ফসল তলিয়ে গেছে। কয়েক হাজার হেক্টর ধান ও সবজির আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি মহান আল্লাহর কাছে কত সুউচ্চ মর্যাদা রাখে, তা আমরা সবাই জানি। শুধু মানুষই নয়; হাদিসের বর্ণনামতে যেকোনো প্রাণীর বিপদে এগিয়ে যাওয়াই সওয়াবের কাজ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীর সেবাতে রয়েছে প্রতিদান।’ (সহিহ বুখারি)
যেকোনো প্রাণীর সেবায় প্রতিদান থাকলেও মানুষের সেবা করা করার প্রতিদান বেশি। আর যদি কোনো মুমিন ব্যক্তির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা যায়, তাহলে কথাই নেই। এতে যেন নিজেকে সরাসরি মহান আল্লাহর সেবাতেই নিয়োজিত করা যায়। পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় সৌভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে? হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা বলবেন, হে আদমসন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি আমার শুশ্রুষা করোনি। সে বলবে, হে আমার প্রভু! আমি কীভাবে আপনার শুশ্রুষা করব, আপনি তো বিশ্বজগতের প্রভু! আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল? তুমি তার শুশ্রুষা করোনি। তুমি যদি তার শুশ্রুষা করতে, তাহলে আমাকে তার কাছে পেতে। হে আদমসন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম। তুমি আমাকে খাবার দাওনি। সে বলবে, হে প্রভু! আমি কী করে আপনাকে খাওয়াব, আপনি তো বিশ্বজগতের প্রভু! আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, তখন তুমি তাকে খেতে দাওনি। তুমি কি জানতে না, তুমি যদি তাকে খাওয়াতে, তাহলে আমার কাছে পেতে? হে আদমসন্তান! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে পানি দাওনি। সে বলবে, হে প্রভু! কীভাবে আমি আপনাকে পানি পান করাব, আপনি তো সারা জাহানের প্রভু! তিনি বলবেন, তুমি যদি তাকে পান করাতে, তাহলে তা আমার কাছে পেতে। (সহিহ মুসলিম)
দানের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো কার্পণ্য ও লোভ। এগুলো পরিহার করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। কারণ যে দান করে তার ব্যাপারে অনেক বড় সুসংবাদের ঘোষণা এসেছে। এর বিপরীতে যে কার্পণ্যতায় লিপ্ত থাকে তার ধন-সম্পদ ধ্বংস করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেশতা নেমে আসে। তাদের একজন দোয়া করে, হে আল্লাহ! যে সম্পদ ব্যয় করে তাকে আপনি এর বদলা দান করুন। অন্যজন দোয়া করে, হে আল্লাহ! যে সম্পদ জমিয়ে রাখে তার সম্পদ ধ্বংস করে দিন। (সহিহ বুখারি)
বিভিন্ন দুর্যোগে অসহায়দের সরাসরি সহায়তা করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিত বন্ধুমহল থেকে অর্থ উত্তোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করে তা পৌঁছে দিতে পারি। অনেকেই এমন থাকেন, যারা এসব ক্ষেত্রে দান করতে চান। কিন্তু কীভাবে দান করবেন, কার মাধ্যমে পৌঁছাবেন ইত্যাদি ভাবনায় আর হয়ে ওঠে না। এমন সময় আশপাশের কেউ উদ্যোগী হলে তাদের দান সহজেই বিপর্যস্ত মানুষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং উদ্যোগ গ্রহণের কারণে ব্যক্তি নিজেও বিশাল সওয়াবের অধিকারী হতে পারে। সুতরাং যার পক্ষে সম্ভব অন্যদের থেকে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগের মাধ্যমেও এগিয়ে আসতে পারি। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করো।’ (সুরা মায়েদা ২)
তাই আসুন উম্মতের এই ক্লান্তিলগ্নে আমরা একে অন্যের পাশে দাঁড়াই। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিই অসহায়ের প্রতি। সফলতা লাভ করি ইহকাল ও পরকালে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে উম্মতের সার্বিক খেদমতে নিয়োজিত থাকার তওফিক দিন।
ভয়েস/আআ