শুক্রবার, ২৭ Jun ২০২৫, ০৯:১১ অপরাহ্ন
মোস্তফা কামাল:
রপ্তানির নির্ধারিত শেষ দিনে রবিবার বেনাপোল বন্দর দিয়ে ৩৬ হাজার কেজি ইলিশ রপ্তানি হয়েছে ভারতে। ১১ দিনে মোট রপ্তানি হলো ৫ লাখ ৩২ হাজার কেজি ইলিশ। শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতের অনুরোধে ৪৯টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে দুই হাজার ৪২০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয় সরকার। প্রতি কেজির দাম ধরা হয় ১০ মার্কিন ডলার বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ১৮০ টাকা। এতে দেশ পায় ৫৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। এর মধ্যেই মা ইলিশ রক্ষায় রবিবার থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। আশ্বিন মাসে ৮০ ভাগ ইলিশের পেটে ডিম আসে বলে প্রচারিত। কেবল মিঠাপানিতে ডিম ছাড়ার কারণে এ সময় ইলিশ সাগরের নোনাজল ছেড়ে নদীমুখী হয়। পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় পানি বাড়তে থাকলে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ নদীতে আসে। প্রজনন নিরাপদ করতে তাই প্রতি বছর এই সময়ে ইলিশ ধরায় দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা।
দিনে দিনে ইলিশ আর কেবল একটি ফিশ নয়। এটি হয়ে গেছে রাজনীতি-অর্থনীতি, কূটনীতিও। প্রতিবেশী বাংলাদেশ-ভারতের কূটনীতির সম্পর্কে ইলিশ আরও জায়গা করে নিয়েছে এবার। ইলিশ আভিজাত্যের বিষয়ও। বরেণ্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর বিভিন্ন লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে বাংলার ইলিশের অতুলনীয় স্বাদ। ‘আড্ডা’ নামের এক প্রবন্ধে তিনি বেহেশতি খাবারের প্রসঙ্গ তুলে ইলিশকে ‘অমৃত’র আসনে বসিয়েছেন। একবার এক পাঞ্জাবি অধ্যাপকের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী জোর গলায় বলেন, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার হলো সরু চালের ভাত আর ইলিশ। ইলিশকে এমনিতেই পূজার অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেন অনেকে। প্রথমে বলা হয়, ভারতকে আর ইলিশ দেওয়া হবে না। ইলিশ পাচারে কড়া শাস্তির হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। কিছু ধরপাকড়ও চলে। পরে বলা হয়, ভারতকে পূজায় ইলিশ উপহার দেওয়া হবে। দিন কয়েকের মধ্যে পরে আবার কথা বদলে বলা হয়, উপহার নয় বাণিজ্যিক কারণে ইলিশ রপ্তানি করা হয়েছে। ইলিশ নিয়ে কথার কচলানি স্যোশাল মিডিয়ায় আরও ব্যাপক।
ইলিশ এক পর্যায়ে আইন আদালতের বিষয়ও হয়েছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্র্তৃক ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। রিট পিটিশনে ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি বাতিলসহ বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা ও নদীর ইলিশ মাছ রপ্তানির বিরুদ্ধে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের রপ্তানি নীতি ২০২১-২৪ অনুযায়ী, ইলিশ মাছ মুক্তভাবে রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য নয়। এই মাছ রপ্তানি করতে চাইলে যথাযথ শর্ত পূরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এককভাবে এই ইলিশ মাছ রপ্তানির অনুমোদন দিতে পারে না। এটা এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজ করেছেন এবং বাংলাদেশের সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছেন।
আইনি এ পদক্ষেপটি এখন তামাদির খাতায়। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ত্রিপুরা ও আসামেও যায় বাংলাদেশের ইলিশ। বছর জুড়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলাদেশের ইলিশের জন্য মুখিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে আমদানি হওয়া ইলিশের সিংহভাগই পেয়ে থাকে পশ্চিমবঙ্গ। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাংলাদেশ থেকে ইলিশ যায় ভারতে। ভারতীয় বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশি জিআই পণ্যখ্যাত ইলিশ নিয়ে কত ক্যাচাল। দুর্গাপূজা, পহেলা বৈশাখ এবং জামাইষষ্ঠীর সময় পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ পাঠিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কূটনীতির নতুন মাত্রা যোগ করেন। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলত তার ইলিশ কূটনীতি। ২০১২ সাল থেকে অন্যান্য দেশে রপ্তানি বন্ধ থাকলেও ভারতে মাছ বিক্রির অনুমতি দিত হাসিনার সরকার। গত বছরও চার হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর আরেক চিত্র। এ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বাংলাদেশে ভারতবিরোধী বাতাসে খুব ঝাঁজ। তা পড়ে ইলিশের ওপরও। এর মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতারের এক বক্তব্য নতুন করে আলোচনার জন্ম দেয়। উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি ঘোষণা দেন আগে দেশের মানুষ ইলিশ খাবে তারপর রপ্তানি। সে সময় তিনি বলেন, এবারের দুর্গোৎসবে বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ অন্য নাগরিকরা যেন ইলিশ খেতে পারেন সেটি নিশ্চিত করা হবে। ভারতের চেয়ে দেশের জনগণকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে।
এ পরিস্থিতির মধ্যেই ভারতের ফিশ ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন ইলিশ রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানায়। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের কাছে চিঠি পাঠিয়ে আবেদন করে ফিশ ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন। পরবর্তী সময়ে দুর্গাপূজা উপলক্ষে সরকার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, ‘বৃহত্তর স্বার্থে এবং সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্তে ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে। ভারতে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্তে বাহবা পেয়েছি। অনেক জায়গা থেকে বলা হয়েছে, ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ ওই দিন বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, বছরে উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৩০ হাজার টন ইলিশ। তিন হাজার টন ইলিশ চাঁদপুর ঘাটের এক দিনের পরিমাণের চেয়ে কম। তাছাড়া, ইলিশ রপ্তানিতে বাণিজ্যিক সুবিধাও আছে। বৈদেশিক মুদ্রা আসবে। রপ্তানি না করলে চোরাচালান হয়।
অনেক কিছুর অভাব থাকার পরও বাংলাদেশ রপ্তানি করে। তা একদিকে সক্ষমতার স্মার্টনেস। আরেক দিকে, কিছু ডলার আমদানি। এ বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনীতি, কূটনীতির একটা মিশেল থাকে। এর মধ্যে ইলিশ অন্যতম। কিন্তু, সেই ইলিশও দিনে দিনে অত্যাচারের শিকার। ডুবোচরে বাধা পেয়ে ইলিশ ছুটে যাচ্ছে ভিন্ন পথে। ডিম ছাড়ছে ‘অন্য বাড়িতে’। সেই ডিম ফুটে বের হওয়া ছা-পোনারা খাবারের খোঁজে এসে আটকে যাচ্ছে ডুবোচরগুলোতে। আর ডুবোচর তৈরি হয় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে এবং মানুষের অবিবেচক-অবৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে। সেখানে ঢুকে পড়ে অন্য মাছের পোনারাও। সেখানে বাছবিচারের অবস্থা নেই জেলেদের। মাছ ধরা দিয়ে কথা। তাদের জালে ছোট-বড়-মাঝারি মাছই ধরা পড়ে। সেগুলো চলে যায় আড়তদারের হাতে। এমনিতেই কয়েক বছর ধরে ভরা মৌসুমে নদীতে কাক্সিক্ষত ইলিশ উঠছে না। এর প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের বৃষ্টি আইন বদলে যাচ্ছে। বর্ষার বড় সময় জুড়ে বৃষ্টি থাকছে না, আবার হঠাৎ হঠাৎ অনেক বৃষ্টি হচ্ছে।
আষাঢ়ের শুরু থেকে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে ইলিশের পেটে ডিম আসে না। অতিরিক্ত খরা, অনাবৃষ্টি, প্রচণ্ড গরম, পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা অস্বাভাবিক হলেও ইলিশের পেটে ডিম আসে না। পেটে ডিম না এলে ইলিশ সাগর থেকে নদীতেও আসে না। এর সঙ্গে নদীর স্রোত ও পানির গভীরতাও সম্পর্কিত। নদী থেকে সাগর, সাগর থেকে নদী ইলিশের গতিপথ। এই মাইগ্রেটরি রুট ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীতে ইলিশ কম উঠছে। ইলিশের জাটকা-পোনা, ছোট ছোট মাছ ও বাচ্চারা ৩-৪ ফুট পানিতে থাকে। গভীর পানির চাপ সহ্য করতে পারে না। তাই জোয়ারের সময় খাবারের সন্ধানে বাচ্চাগুলো ডুবোচরে আশ্রয় নেয়। আর এই আশ্রয়স্থলগুলো হয়ে উঠছে ইলিশের ছা-পোনাদের মরণস্থল। জেলেদের নিষিদ্ধজাল ইলিশের বংশবিনাশও করছে।
মেঘনা ও সাগর মোহনায় দেখা যায়, কিছু দূর পরপর লোহার ড্রাম, প্লাস্টিকের কনটেইনার, খুঁটির মাথা বের হয়ে আছে। এলাকাবাসী এগুলোকে বলে বিন্দিজাল। মুখ হাঁ করে রাখা এ জাল যা পায় তা-ই গিলে খায়। জাটকার বেশি ক্ষতি করে এই বিন্দিজাল। খুঁটি জাল, পিটানো জাল, মশারিজাল, ঘেরাজাল, পাইজাল, ঘুণ্টিজাল, তার ওপর কারেন্ট জাল তো আছেই। ইলিশের আরেক শত্রু বালু ডাকাতরা। নদীতে কাক্সিক্ষত ইলিশ না ওঠার আরেক কারণ ভরা মৌসুমে মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদী থেকে বালু ডাকাতি। এছাড়া, ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধের সময় ভারতের জেলেরা বাংলাদেশের সীমান্তের পিরোজপুর-চাঁদপুর পর্যন্ত ঢুকে মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। এ কারণে বা ভারতে পাচার বা রপ্তানির কারণেই দেশে ইলিশের দাম এত চড়া, সে কথা বলার অবস্থাও নেই। ইলিশকে ঘিরে দাদনের কারবারের কথা আলোচনায় তেমন আসছে না। এই দাদন চক্রের পরতে পরতে নানা ফাঁদ। এই কারবারিরা একই সঙ্গে ইলিশের ক্রেতাও, বিক্রেতাও। এই দাদনের শাঁখের করাতে কাটাকুটির কত যে খেলা! নিষিদ্ধ নানান জালের সঙ্গে দেশের ইলিশ-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে দাদনওয়ালাদের বিছানো জালের বিষয়েও সিদ্ধান্ত দরকার।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
mostofa71@gmail.com
ভয়েস/আআ/সূদ্র: দেশ রূপান্তর