বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:৫৫ পূর্বাহ্ন
আবদুর রাকীব মাসুম:
বাকস্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। মহান আল্লাহর এ এক বিশেষ নেয়ামত যে, মানুষ তার মনের কথা যেভাবে চায়, সেভাবে প্রকাশ করতে পারে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তিনি তাকে (মানুষকে) কথা বলা শিখিয়েছেন।’ (সুরা আর-রহমান ৪) বাকস্বাধীনতার অর্থ হলো, স্বাধীনভাবে নিজের মত ও বক্তব্য প্রকাশ করতে পারা, যা অন্যের স্বাধীনতা কিংবা অধিকারকে ক্ষুন্ন করে না।
বাকস্বাধীনতা না থাকলে সমাজে জুলুমের প্রসার হয়। মানুষের অধিকার খর্ব হয়। রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়। তাই ন্যায় ও মানবতার ধর্ম ইসলামে বাকস্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যখন পৃথিবীতে বাকস্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না, রাজা-বাদশাহ আর গোত্রপতিদের কথাই ছিল চূড়ান্ত, তখন আপত্তি বা ভিন্নমত জানানোর সাহস কারও ছিল না। এমন সময় পৃথিবীতে আগমন ঘটে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর। তিনি মানুষকে আলোর পথ দেখান, সভ্যতার শিক্ষা দেন এবং তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেন।
ইসলামে জুলুম ও স্বেচ্ছাচারিতার কোনো স্থান নেই। রাজা-প্রজা, মনিব-ভৃত্য কেউই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়। সবাইকেই একদিন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সহিহ বুখারি)
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।’ (সুরা আহজাব ৭০) এখানে সঠিক কথার অর্থ হলো, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে বলা হয় এবং তাতে কোনো কপটতার আশ্রয় নেওয়া হয় না।
ইসলাম মানুষকে মুক্তভাবে কথা বলার অধিকার দিয়েছে। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘সর্বোত্তম জিহাদ হলো জালেম বাদশাহের সম্মুখে সত্য কথা উচ্চারণ করা।’ (জামে তিরমিজি ২১৭৪)
নবীজি (সা.) মানুষের মতামতকে সম্মান করতেন। ধৈর্য সহকারে তাদের কথা শুনতেন। গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে তিনি সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। নবীজি (সা.)-এর ভাষ্য ও জীবনীতে বাকস্বাধীনতার অসংখ্য নজির রয়েছে।
ষষ্ঠ হিজরিতে নবীজি (সা.) মক্কার কাফেরদের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত। এই চুক্তির কিছু ধারা বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের জন্য অবমাননাকর ছিল। তাই সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে তা মেনে নেওয়া কষ্টকর হচ্ছিল। তখন সবার পক্ষ থেকে ওমর (রা.) নবীজির দরবারে উপস্থিত হয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা কি হকের ওপর নই? আর তারা কি বাতিল নয়? নবীজি (সা.) বললেন, অবশ্যই। ওমর (রা.) বললেন, আমাদের মৃতরা কি জান্নাতে আর তাদের মৃতরা কি জাহান্নামে যাবে না? নবীজি বললেন, অবশ্যই। তখন ওমর (রা.) বলেন, তাহলে কেন আমরা তাদের দ্বীনের ব্যাপারে ছাড় দেব? অথচ আল্লাহ এখনো আমাদের এবং তাদের মধ্যে কোনো ফায়সালা করেননি। তখন নবীজি (সা.) উত্তর দিলেন, হে খাত্তাবের পুত্র! নিঃসন্দেহে আমি আল্লাহর রাসুল আর আল্লাহ আমাকে কখনো ধ্বংস করবেন না।’ (সহিহ বুখারি ৩১৮৩)
প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আনাস (রা.) বলেন, একবার আমি নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে হাঁটছিলাম। তার পরনে ছিল একটি মোটা নাজরানি চাদর। তখন এক গ্রাম্য ব্যক্তি এসে সেই চাদর ধরে সজোরে টান দিল। আমি দেখলাম, টানের কারণে নবীজির কাঁধে কাপড়ের দাগ বসে গেছে। তখন ওই লোকটি বলল, আল্লাহর যে সম্পদ আপনার কাছে আছে তা থেকে আমাকে কিছু দিতে আদেশ করুন। তখন নবীজি মুচকি হাসলেন এবং তাকে কিছু দেওয়ার আদেশ করলেন। (সহিহ বুখারি ৩১৪৯)
নবীজীবনের এমন অনেক ঘটনাই হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগ ছিল বাকস্বাধীনতার স্বর্ণযুগ। হজরত আবু বকর (রা.) খলিফা হিসেবে তার প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি যতক্ষণ আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করি, ততক্ষণ আপনারা আমার আনুগত্য করবেন। আর যদি আল্লাহ ও রাসুলের অবাধ্যতা করি, তাহলে আপনারা আমার আনুগত্য করতে বাধ্য নন।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৬/৩০৫)
দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) তার বিখ্যাত ভাষণে বলেছিলেন ‘রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তোমরা আমার অংশীদার। তোমাদের উত্তম পরামর্শ দ্বারা আমাকে সাহায্য করো। আমি যদি আল্লাহ ও রাসুলের পথে চলি, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। আর যদি বিপথগামী হই, আমাকে সংশোধন করো। তোমাদের পরামর্শ ও মতামত দ্বারা আমাকে শক্তিশালী করো।’ তার সময়কালে বাকস্বাধীনতার নমুনা হিসেবে একটা ঘটনা উল্লেখ করা যায়, একবার মুসলমানদের মধ্যে চাদর বণ্টন করা হয়। সবার ভাগে একটি করে চাদর পড়ে। জুমার দিন তিনি যখন খুতবা দিতে দাঁড়ালেন, তখন তার গায়ে দুটি চাদর দেখতে পেয়ে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, আমরা আপনার কথা শুনব না, যতক্ষণ না আমার কথার উত্তর দেবেন। আমরা সবাই পেয়েছি একটি চাদর, তাহলে আপনার গায়ে দুটি কেন? অর্ধ পৃথিবীর শাসক হজরত ওমর (রা.) তার দুঃসাহসী প্রশ্নে রেগে যাননি। মুখে হাসি রেখে বললেন, এই প্রশ্নের উত্তর আমার ছেলে আবদুল্লাহ দেবে। তখন তার ছেলে আবদুল্লাহ (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, আমার বাবা একটি চাদরই পেয়েছিলেন, তবে আমি আমার চাদর তাকে দিয়েছি। তাই তিনি দুটি চাদর পরেছেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
এগুলো হচ্ছে ইসলামি ইতিহাসে বাকস্বাধীনতার চমৎকার কিছু দৃষ্টান্ত মাত্র। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা স্পেন বিজয় করার আগ পর্যন্ত বাকস্বাধীনতা বলতে যে কিছু একটা আছে, ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্বের সেটা জানা ছিল না। অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপ তখন মানবেতর জীবনযাপন করত। সম্রাট আর গির্জার পাদ্রিদের স্বেচ্ছাচারিতার সামনে সবাই ছিল অসহায়। এমনকি বৈজ্ঞানিক থিওরি প্রকাশের জন্য জীবন দিতে হয়েছে অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে। তখন পশ্চিমা বিশ্বকে বাকস্বাধীনতার সঙ্গে পরিচিত করিয়েছিল মুসলমানরা। এটা ইতিহাসের ধ্রুব সত্য একটি বিষয়। আধুনিক বিশ্বে পশ্চিমারা বাকস্বাধীনতার বুলি আওড়ায়, কিন্তু তাদের সেই বাকস্বাধীনতার অর্থ বড়ই অদ্ভুত। পশ্চিমাদের কাছে বাকস্বাধীনতার অর্থ হলো অশ্লীলতা ও অন্য সম্প্রদায়ের বিরোধিতা।
তবে ইসলামে বাকস্বাধীনতার সংজ্ঞা পশ্চিমাদের থেকে ভিন্ন। ইসলামে বাকস্বাধীনতা তো রয়েছে, কিন্তু তা পশ্চিমাদের মতো পক্ষপাতদুষ্ট নয়। ইসলামে বাকস্বাধীনতার নির্দিষ্ট কিছু সীমারেখা রয়েছে। যেমন বাকস্বাধীনতা চর্চা করতে গিয়ে যেন গিবত বা পরনিন্দা না হয়ে যায়, মিথ্যা ও গুজবের আশ্রয় যেন না নেওয়া হয় এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্য যেন না হয়।
ভয়েস/আআ