শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ০৬:১৭ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

পুরনো সমস্যা আর নতুন দল

রাজেকুজ্জামান রতন:
নতুন দল গড়ার ঘোষণার পাশাপাশি বিপুল আয়োজন দেখছে দেশের মানুষ। বলা হচ্ছে, পুরনো দল আর পুরনো চিন্তা দিয়ে চলবে না। ফলে নতুন দল চাই, চাই নতুন ধরনের সরকার। কিন্তু দেশের মানুষ তো ঘর পোড়া গরুর মতো। তাই সন্দেহ জেগে ওঠে, নতুন কথা বলে পুরনো পথেই হাঁটবে না তো? ইতিমধ্যেই ছাত্রদের নিয়ে গড়া সংগঠনে পদ নিয়ে বিরোধ, সহিংসতা আর নতুন দলে হাল ধরবেন কারা সেই বিতর্কে মানুষ ভাবতে শুরু করেছে এই দল দেশের হাল ফেরাতে কি ভূমিকা রাখবে? ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করতে গণঅভ্যুত্থান করেছে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। জীবন দিয়েছে, নির্যাতন সয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতি ঘৃণা আর বৈষম্যবিহীন দেশ গড়ার প্রত্যাশায়। বাংলাদেশে যত সমস্যা আছে তার রূপ যাই হোক না কেন, প্রকৃতি তো একই। সমাজটা পুঁজিবাদী এবং শোষণমূলক ফলে বৈষম্য সর্বত্র। বৈষম্য নারী পুরুষের, পাহাড় সমতলের, গ্রাম শহরের, ধর্মীয় ভিন্নতায়, সরকারি-বেসরকারি এবং প্রধানত ধনী-গরিবে। বৈষম্যের প্রকাশ হিসেবে প্রতিটি স্তরেই সমস্যা প্রকট রূপ ধারণ করছে। বাংলাদেশের মানুষের কত ধরনের সমস্যা আছে তা জানার জন্য গবেষণা বা খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। প্রতিদিন একবার করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে একটু ঘুরে এলেই হবে। সমাজে কত ধরনের বৈষম্য, বঞ্চনা আছে তার একটা চিত্র যেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের চত্বর। কারা নেই এখানে? দাবি জানানোর জন্য একত্রিত হওয়ার আর তো কোনো জায়গা নেই ঢাকা শহরে। ফলে সবাই আসছেন তাদের দাবি জানাতে, সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। মনে একটু আশা, যদি উপদেষ্টারা একটু শোনেন তাহলে হয়তো তারা কষ্টের হাত থেকে একটু বাঁচতে পারবেন।

বাংলাদেশ ভরসা করে কাদের ওপর? দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত, অন্যদিকে জনসংখ্যার ঘনত্ব পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন এবং ভারত। দুই দেশেরই জনসংখ্যা এখন ১৪০ কোটিরও বেশি। কিন্তু প্রতি বর্গকিলোমিটারে কতজন বাস করে এই হিসেবে পৃথিবীতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ১২০০ জন, যেখানে চীনে বাস করে ১৪৯ জন আর ভারতে ৪১২ জন। অর্থাৎ প্রতি বর্গকিলোমিটারে চীনের চেয়ে ৮ গুণ আর ভারতের চেয়ে ৩ গুণ মানুষ বাস করে এই বাংলাদেশে। এই যে বিপুল সংখ্যক মানুষ বাস করেন এ দেশে তাদের খাদ্য, পোশাক, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানের দায়িত্ব নেওয়া রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। আবার যখন সম্পদ কম কিন্তু প্রয়োজন বেশি তখনই তো প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা, যাতে সীমিত সম্পদে দেশের মানুষের প্রয়োজন মেটানো যায়। তাই উৎপাদনের জন্য শ্রমিক-কৃষকের ওপর যেমন নির্ভর করতে হবে, তেমনি দক্ষ মানুষ তৈরি করতে নির্ভর করতে হবে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অংশ হলো শিক্ষক সম্প্রদায়। মানুষের অভিজ্ঞতা আর গবেষণায় অর্জিত জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিতরণ করা শিক্ষকের দায়িত্ব। বর্তমানের শিক্ষায় ভবিষ্যতের পথ চলতে সাহায্য করেন বলেই তাদের বলা হয়ে থাকে মানুষ গড়ার কারিগর। তারা বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সাহায্য করেন। একটা জাতি কত দূর এগিয়ে যাবে তা নির্ভর করে শিক্ষাব্যবস্থা কতটা উন্নত আর শিক্ষকরা কতখানি দক্ষ। সেই বিবেচনা মাথায় রেখেই শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ১৪৫টি সুপারিশ গৃহীত হয়। এসব সুপারিশের মধ্যে শিক্ষকদের মৌলিক ও অব্যাহত প্রশিক্ষণ, নিয়োগ ও পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, দায়িত্ব ও অধিকার, শিক্ষাসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা অন্যতম। কিন্তু বাংলাদেশ এর কতটা মেনে চলছে তা খুঁজতে গেলে হতাশ হতে হবে।

প্রেস ক্লাবের সামনে রাস্তা জুড়ে বসে আছেন শিক্ষকরা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষক, নন-এমপিও শিক্ষকসহ হাজার হাজার শিক্ষক। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দফায় দফায় শিক্ষকরা এসেছেন। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, বিভিন্ন নামের সংগঠন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় এসে রোদ-বৃষ্টিতে রাস্তায় পড়ে আছেন। এবারই নয়, বহু বছর ধরে খুবই যুক্তিসংগত দাবি নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। বহুবার তারা ঢাকায় এসেছেন, পুলিশের মার খেয়ে রক্ত ঝরিয়েছেন, জলকামানের পানিতে ভিজেছেন, টিয়ার শেলে চোখের জল ঝরিয়েছেন, নিজেরা কেঁদেছেন, অনেককে কাঁদিয়েছেন, বহুবার সরকারের প্রতিশ্রুতি পেয়ে সরল বিশ্বাসে তারা ফিরে গেছেন কাজে। কিন্তু অতীতের সরকার বারবারই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। ২০০৬ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই দাবি নিয়ে নন-এমপিও শিক্ষকরা এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ বার ঢাকা শহরে এসেছেন। এবারও এসেছেন এবং পাঁচ দিন ধরে বসে আছেন, এখনো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কেউ আশ্বাসবাণী শোনাতে আসেনি তাদের কাছে। এই শিক্ষকরা ২০১৩ সালে যখন এসেছিলেন, তখন পুলিশের লাঠি, স্প্রে, মরিচের গুঁড়া সবই প্রয়োগ করা হয়েছে তাদের ওপর। সেবার শিক্ষামন্ত্রী তিন মাসের মধ্যে সব দাবি মেনে নেবেন বলেছিলেন, তার আশ্বাসে ভরসা করে বুকভরা আশা নিয়ে শিক্ষকরা আবার ক্লাসে ফিরেছিলেন, কিন্তু সেই দাবি পূরণ হয়নি। প্রতারিত, প্রত্যাখ্যাত শিক্ষকরা কী করবেন? তারা তো হরতাল ডাকতে পারেন না, ভাঙচুর জ¦ালাও-পোড়াও করতে পারেন না। তাদের পেছনে আছে অভাব ক্লিষ্ট পরিবার, এলাকায় তাদের পরিচিতি শিক্ষক হিসেবে, ফলে রাস্তায় এসে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না তাদের। সচিব থেকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়ে তারা কাজে ফিরে যান। কিছুদিন পর যখন দেখেন তাদের প্রত্যাশা এবং সরকারের প্রতিশ্রুতি কোনোটাই পূরণ হচ্ছে না তখন আবার আসেন ঢাকায়, ঠিকানা বেছে নেন প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তা এবং তাদের অমানবিক কষ্টের কথা তুলে ধরে মানবিক আবেদন জানাতে থাকেন।

শিক্ষকদের দাবি একটাই সরকার যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এমপিও বা মান্থলি পে-অর্ডার ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি স্বীকৃতি পেতে হলে প্রথমেই ১৩-১৪টি শর্ত পূরণ করতে হয়। নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিও কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করার কাজ ২০০৪ সাল পর্যন্ত ঠিকমতোই চলেছিল বলে শিক্ষক নেতারা মনে করেন। এরপর থেকে এটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষক প্রতিনিধিরা বহুবার সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করেছেন। এই সময়কালে সরকার ভিন্ন হলেও কথা কিন্তু ভিন্ন ছিল না। প্রতিবারই বলা হয়েছে, ‘সরকারের টাকা নেই’। শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে ২০১০ সালে প্রায় দেড় হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, ২০১৮ সালে এবং ২০২১ সালেও কিছু প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়, কিন্তু সমস্যার সার্বিক সমাধান হয়নি। শিক্ষকরা বলছেন, যেসব প্রতিষ্ঠান শর্ত মেনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, পাঠদান ও পরীক্ষা নিচ্ছে, যে শিক্ষকরা লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে পড়াচ্ছেন সব প্রতিষ্ঠানই এমপিওর আওতাভুক্ত করা হোক। এমনকি তারা এটাও বলেছেন, টাকার অভাব থাকলে বরং ধাপে ধাপে টাকা দেওয়া হোক, কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গেই অন্তর্ভুক্ত করুন, এই অপমান আর অনিশ্চয়তার জীবন থেকে একটু স্বস্তি আর সম্মানের জীবনে নিয়ে আসুন। রাস্তায় যারা বসে আছেন তারা শিক্ষক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার। ছাত্রদের চোখে তারা অনুসরণীয় আর এলাকাবাসীর কাছে সম্মানিত। তাদের প্রতিষ্ঠান সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, সরকার তাদের দিয়ে নির্বাচন, শুমারি, নানাবিধ জরিপ-সবই করায়। এখানে নিয়মিত ক্লাস হয়; পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি সব পরীক্ষা হয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এত সব দায়িত্ব পালন করার পরও মাসের পর মাস বছরের পর বছর সরকারের কাছ থেকে তাদের বেতন আসে না। আসে না বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা। এগুলো ছাড়াই এই শিক্ষকেরা ক্লাস নিতে থাকেন, অন্য সব কাজ করেন বছরের পর বছর। বয়স বাড়ে, সংসারের খরচ বাড়ে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ আর নিজের জীবনের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে ঘুম হারাম হয়ে যায়। বুকে কষ্ট চেপে আবার পথে নামেন প্রতিষ্ঠান এবং নিজের চাকরিটা এমপিওভুক্ত যেন হতে পারে এই আশায়।

শিক্ষকদের জীবন যেন বেদনার একেকটা মহাকাব্য। বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় কেউ দোকান নিয়েছেন, কেউ দিনমজুরির কাজ নিয়েছেন, রিকশা চালানোর ঘটনাও আছে। আর আছে ঋণের বোঝা। এমনিতেই শিক্ষকদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা বিশ্বের অন্য সব দেশের তুলনায় কম। আর তাদের মধ্যেও নিরাশ্রয় এই বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকরা। কয়েকশ কোটি টাকা হলে সব শিক্ষকের ন্যূনতম দাবি পূরণ হয়, সরকার তাদের শ্রম নেবে কিন্তু বেতন দেবে না, কারণ ‘সরকারের টাকা নেই’! ফ্যাসিবাদী সরকার দমন আর দুর্নীতির পথ বেছে নিয়েছিল। রাস্তায় পুলিশ দিয়ে পেটানো আর টাকার বিনিময়ে এমপিওভুক্ত করা এটা ছিল তাদের কাজ। অন্তরর্তী সরকারের কাছে তাই শিক্ষকদের ভরসা আর প্রত্যাশা বিপুল। সরকার অন্তত তাদের কথা শুনবেন, সামর্থ্যরে মধ্যেই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবেন, পরবর্তী সরকারের জন্য নির্দেশনা রেখে যাবেন, শিক্ষকদের আর রাস্তায় বসে থাকতে হবে না। নতুন বন্দোবস্ত এই কথাটা শোনা যাচ্ছে হরদম। কিন্তু পুরনো ব্যবস্থায় সৃষ্ট বেদনাগুলো দূর করার নতুন পদক্ষেপটা দৃশ্যমান হচ্ছে না তেমন। অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষার মান এবং শিক্ষকের জীবনমান উন্নয়নে যে পদক্ষেপ নেবে তা আগামীর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এই প্রত্যাশায় শিক্ষকরা বসে আছেন ফুটপাতে।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

rratan.spb@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION