রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ১০:১৩ অপরাহ্ন
মুফতি মাহবুব হাসান:
ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। এ মাসটি ইতিহাস, স্মৃতি, আত্মশুদ্ধি ও আত্মত্যাগের এক অনন্য প্রতীক। এ মাসে আশুরার দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য মুসলিম মানসে গভীরভাবে প্রোথিত। যদিও অনেকেই মনে করেন, কারবালার শোকাবহ ঘটনার কারণেই আশুরার মাহাত্ম্য এত উচ্চ, তবে এ ধারণা একপাক্ষিক ও অসম্পূর্ণ। ইসলামি ঐতিহ্য ও নবুয়তি ইতিহাসে আশুরার দিন বহু যুগান্তকারী ঘটনার সাক্ষী। সৃষ্টি থেকে শুরু করে নবীদের নানা ঐতিহাসিক ঘটনার ধারা আশুরার দিনকে করেছে ব্যতিক্রমী ও মর্যাদাবান। মহররম মাসের শিক্ষায় রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণ, ত্যাগ ও নৈতিকতা বিকাশের দিকনির্দেশনা।
পৃথিবীতে অনেক স্মরণীয় ও যুগান্তকারী ঘটনা আশুরার দিন ঘটেছিল। মহররম সংগ্রামী শিক্ষা এবং আত্মসচেতনতার মাস। মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী চেতনা খুঁজে পাওয়ার মাস। মহররম আসে দায়িত্ব পালনে সাহসিকতার পথপ্রদর্শক হিসেবে। আসে নির্ভীকভাবে পথচলার কল্যাণময় শুভবার্তা নিয়ে। মহররম আসে পুরনো বছরের জরাজীর্ণতাকে ধুয়ে-মুছে নতুন সাজে সজ্জিত করতে। এ মাস আসে আমাদের নতুন শপথ ও প্রত্যয় গ্রহণের অঙ্গীকার নিয়ে। মহররম মাস এলে মুসলিম বিশে^ জেগে ওঠে ইসলামি সংস্কৃতি, এ মাসে বহু উল্লেখযোগ্য ও ইতিহাস প্রসিদ্ধ ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় বিভিন্ন দিক দিয়ে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
হাদিসে মহররম মাসকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করে একে ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, মহররম মাসের নফল রোজার সওয়াব অন্য সব নফল রোজার সওয়াবের চেয়ে বেশি। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজানের পরে সবচেয়ে বেশি ফজিলতের রোজা হলো, আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।’ এ দিন রোজা পালনের জন্য উৎসাহ ও নির্দেশনা দিয়েছেন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)।
বুখারি শরিফের হাদিসে বলা হয়েছে, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে দেখেন, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা পালন করে। তিনি তাদের বলেন, এ দিনটির বিষয় কী, তোমরা এ দিনে রোজা পালন করো? তারা বলল, এটি একটি মহান দিন। এ দিনে আল্লাহতায়ালা হজরত মুসা (আ.) ও তার জাতিকে পরিত্রাণ দান করেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে নিমজ্জিত করেন। এ জন্য হজরত মুসা (আ.) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এ দিন রোজা পালন করেন। তাই আমরা এ দিন রোজা পালন করি। তখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হজরত মুসা (আ.)-এর বিষয়ে আমাদের অধিকার বেশি। এরপর তিনি এ দিন রোজা পালন করেন এবং রোজা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন।’
ইসলামের বিধান হলো, আশুরার রোজা দুটি রাখা। ১০ তারিখের সঙ্গে মিলিয়ে আগে বা পরে অর্থাৎ নয়-দশ কিংবা দশ-এগারো মহররম রোজা রাখা। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা মুস্তাহাব তথা ঐচ্ছিক বলে গণ্য করা হয়। তবে আশুরার রোজা পালন করলে অফুরন্ত সওয়াব পাওয়া যায়। এ কারণে মহান আল্লাহ বান্দার পূর্ববর্তী বছরের সগিরা গুনাহ মাফ করে দেন। তাই কোনো সচেতন মুসলমান আশুরার রোজা পালন থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চান না।
আশুরার দিন সংঘটিত হওয়া কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরা হলো। আশুরার দিন আকাশ-জমিন ও পাহাড়-পর্বত সবকিছু সৃষ্টি করা হয়। হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়। হজরত আদম (আ.)-কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় পাঠানো হয় এবং গুনাহ মার্জনার পর হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে আরাফাতের ময়দানে জাবালে রহমতে পুনরায় সাক্ষাৎ লাভ করেন। হজরত নুহ (আ.) মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ করেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের প্রজ¦লিত অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি লাভ করেন। দীর্ঘ ১৮ বছর রোগ ভোগের পর হজরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য রোগ থেকে মুক্তি লাভ করেন।
আশুরার দিন হজরত সুলাইমান (আ.)-কে পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজত্বদান করা হয়। হজরত সোলায়মান (আ.)-কে হারানো বাদশাহি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। হজরত ইউনুস (আ.)-কে ৪০ দিন পর দজলা নদিতে মাছের পেট থেকে উদ্ধার করা হয়। হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা পান। হজরত ঈসা (আ.)-এর পৃথিবীতে আগমন এবং জীবিত অবস্থায় আসমানে উত্তোলন। হজরত দাউদ (আ.)-কে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়। হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করতে মদিনায় যান। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার ৭৭ ঘনিষ্ঠজন স্বৈরশাসক ইয়াজিদের সৈন্যের মাধ্যমে কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১/১৩২, ফাতহুল বারী ৪/২৯১)
অনেকে ‘আশুরা’ বলতে কারবালার ঘটনাই বোঝেন। যদিও ইসলামি শরিয়তে আশুরার রোজা কিংবা ফজিলতের সঙ্গে কারবালার ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে কারবালার ঘটনা পর্যালোচনা করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম উম্মাহর জন্য এ ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এখান থেকে শিক্ষণীয় অনেক বিষয় রয়েছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের ৫০ বছর পর ৬১ হিজরি সালের মহররম মাসের ১০ তারিখ শুক্রবার ইরাকের কারবালা নামক স্থানে তারই উম্মতের কিছু মানুষের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন প্রিয়তম দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)। এ ঘটনা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সৃষ্টি করেছে বিভক্তি ও বিভ্রান্তি। অনেক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কাহিনী এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ছড়ানো হয়েছে। এসব বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
ইতিহাসে আছে, ইয়াজিদ ছাড়াও কারবালার ঘটনার সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত রয়েছে কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা এবং গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের নির্মম ষড়যন্ত্র। আশুরার দিন সকাল থেকে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনী হজরত হোসাইন (রা.)-এর সঙ্গীদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। তিনি তো যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে সেখানে যাননি। তিনি কুফায় লক্ষাধিক মানুষের বাইয়াত পত্রের (আনুগত্যের শপথ) আহ্বানে সাড়া দিতে দুগ্ধপোষ্য শিশু ও নারীসহ সেখানে গিয়েছিলেন। তাই প্রস্তুতিহীন যুদ্ধে তার সঙ্গীরা একে একে সবাই শহীদ হন। শহীদ হন হজরত হোসাইন (রা.)। কারবালার ঘটনা থেকে আমরা বর্তমান সময়েও শিক্ষা নিতে পারি। মুসলমানদের ক্ষতির জন্য ষড়যন্ত্রকারীরা মুসলমানদের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। তাই ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সবসময় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও বিভ্রান্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।
ভয়েস/আআ