বুধবার, ০৬ অগাস্ট ২০২৫, ০৮:৪৭ পূর্বাহ্ন
শরিফ আহমাদ:
নবীজি (সা.)-এর হাতে গড়া শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল আসহাবে সুফফা। এখানে এমন কিছু সাহাবি বসবাস করতেন যাদের জীবন ছিল একমাত্র আল্লাহ ও তার রাসুলের সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গিকৃত। তারা দুনিয়ার আরাম-আয়েশ, অর্থ-বিত্ত, পরিবার-পরিজনের মোহ ত্যাগ করে আত্মনিবেদন করেছিলেন দ্বীনের জ্ঞান অর্জন, সাধনা ও প্রচারে। আসহাবে সুফফার অন্যতম সদস্য ছিলেন আবু হুরায়রা (রা.)। তিনি ইলম অর্জনের নেশায় দিনরাত এখানে পড়ে থাকতেন। হাদিস চর্চায় মগ্ন থাকতেন। একদিন তার সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এক বিরল মুজিজা প্রকাশ পায়। এটা একদিকে যেমন দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও কষ্টের সাতকাহন তেমনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দয়া-মায়ার বহিঃপ্রকাশ।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। আমি ক্ষুধার জ্বালায় আমার পেটকে মাটিতে রেখে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতাম। আর কোনো সময় ক্ষুধার জ্বালায় আমার পেটে পাথর বেঁধে রাখতাম। একদিন আমি ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে নবী কারিম (সা.) ও সাহাবিদের বের হওয়ার পথে বসে থাকলাম। অতঃপর আবু বকর (রা.) যেতে লাগলে আমি কোরআনের একটা আয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম এই উদ্দেশে যে, তিনি তাহলে আমাকে পরিতৃপ্ত করে কিছু খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। কিছু করলেন না। কিছুক্ষণ পর ওমর (রা.) যাচ্ছিলেন। আমি তাকে কোরআনের একটি আয়াত সম্বন্ধে প্রশ্ন করলাম। এ সময়ও আমি প্রশ্ন করলাম এ উদ্দেশে যে, তিনি আমাকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। আমার কোনো ব্যবস্থা করলেন না।
তার পরক্ষণে আবুল কাসেম (সা.) যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে দেখেই মুচকি হাসলেন। আমার মধ্যে অস্থিরতা এবং আমার চেহারার অবস্থা থেকে তিনি তা আঁচ করতে পারলেন। তারপর বললেন, হে আবু হুরায়রা! আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি হাজির আছি। তিনি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে চলো। এ বলে তিনি চললেন, আমিও তার অনুসরণ করলাম। তিনি ঘরে ঢুকবার অনুমতি চাইলেন এবং আমাকেও ঢুকবার অনুমতি দিলেন। তারপর তিনি ঘরে প্রবেশ করে একটি পেয়ালার মধ্যে কিছু পরিমাণ দুধ পেলেন। তিনি বললেন, এ দুধ কোথা থেকে এসেছে? তারা বললেন, এটা আপনাকে অমুক পুরুষ অথবা অমুক মহিলা হাদিয়া দিয়েছে। তখন তিনি বললেন, হে আবু হুরায়রা! তুমি সুফফাবাসীদের কাছে গিয়ে তাদের আমার কাছে ডেকে নিয়ে আসো।
হাদিস বর্ণনাকারী বলেন, সুফফাবাসীরা ইসলামের মেহমান ছিলেন। তাদের কোনো পরিবার ছিল না, কোনো সম্পদ ছিল না এবং তাদের কারও ওপর নির্ভরশীল হওয়ারও সুযোগ ছিল না। যখন কোনো সাদকা আসত তখন তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। তিনি এর থেকে কিছুই গ্রহণ করতেন না। আর যখন কোনো হাদিয়া আসত, তখন তার কিছু অংশ তাদের দিয়ে দিতেন এবং এর থেকে নিজেও কিছু রাখতেন। সুফফাবাসীদের তার কাছে আসতে বলার আদেশ শুনে আমার মনে কিছুটা হতাশা এলো। মনে মনে ভাবলাম, এ সামান্য দুধ দ্বারা সুফফাবাসীদের কী হবে? এ সামান্য দুধ আমার জন্যই যথেষ্ট হতো। এটা পান করে আমি শরীরে কিছুটা শক্তি পেতাম। এরপর যখন তারা এসে গেলেন, তখন তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন, আমিই যেন তা তাদের দিই, আমার আর আশা রইল না যে, এ দুধ থেকে আমি কিছু পাব। কিন্তু আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ না মেনে কোনো উপায় নেই। নবীজি (সা.) বললেন, হে আবু হুরায়রা! তুমি পেয়ালাটি নাও আর তাদের দাও। আমি পেয়ালা নিয়ে একজনকে দিলাম। তিনি পরিতৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। আমি আরেকজনকে পেয়ালাটি দিলাম। তিনিও পরিতৃপ্ত হয়ে পান করে পেয়ালাটি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। এমনকি আমি এভাবে দিতে দিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত পৌঁছলাম। তারা সবাই তৃপ্ত হয়েছিলেন।
তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) পেয়ালাটি নিজ হাতে নিয়ে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আর বললেন, হে আবু হুরায়রা! এখন তো তুমি আর আমি আছি। তুমি বসে পান করো। তখন আমি বসে কিছুটা পান করলাম। তিনি বললেন, তুমি আরও পান করো। আমি আরও পান করলাম। তিনি বারবার আমাকে পান করার নির্দেশ দিতে লাগলেন। এমনকি আমি বলতে বাধ্য হলাম যে, আর না। যে সত্তা আপনাকে সত্য ধর্মসহ পাঠিয়েছেন, তার কসম! আর পান করার মতো আমার পেটে জায়গা পাচ্ছি না। তিনি বললেন, তাহলে আমাকে দাও। আমি পেয়ালাটি তাকে দিয়ে দিলাম। তিনি আলহামদুলিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ বলে বাকিটা পান করলেন। (সহিহ বুখারি ৬৪৫২) এ হাদিস থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা ও উপদেশ পাওয়া যায়। সেগুলো উল্লেখ করা হলো।
নবীজির মুজিজা প্রকাশ : সাধারণত এক পেয়ালা দুধ এক-দুজনের পিপাসা নিবারণে যথেষ্ট। কিন্তু এই অল্প দুধে বহু সাহাবি পরিতৃপ্ত হলেন। আবু হুরায়রা (রা.)-এরও পেট ভরল। তারপরও কিছু দুধ রইল যা নবীজি (সা.) নিজে পান করলেন। নিঃসন্দেহে এটি ছিল নবীজি (সা.)-এর বিস্ময়কর মুজিজা।
ইলমের জন্য ত্যাগ ও ধৈর্য : ইলম অর্জন করার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করতে হয়। আবু হুরায়রা (রা.)-এর ক্ষুধার্ত জীবনের ঘটনা শেখায় দ্বীনের ইলম একাগ্রতা, আত্মত্যাগের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। যারা দ্বীনের আলোয় জীবন গড়তে চায়, তাদের সাহাবিদের মতো ত্যাগের আদর্শ গ্রহণ করতেই হবে।
আনুগত্যের মধ্যে প্রকৃত কল্যাণ : আবু হুরায়রা (রা.) দোটানার মধ্যে ছিলেন, এই সামান্য দুধ সবাইকে দিলে শেষ অবধি সে নিজে পাবে কি না! কিন্তু নবীজি (সা.)-এর নির্দেশ সবার ঊর্ধ্বে। তাই তিনি ক্ষুধার অসহ্য কষ্ট সত্ত্বেও পুরোপুরি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। এর ফলস্বরূপ শেষে আল্লাহ তার পেট পরিপূর্ণ করে দিলেন। এটাই প্রমাণ করে আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশ মেনে চললে কল্যাণ সুনিশ্চিত।
তালিবুল ইলমদের পাশে থাকা : সুফফার সাহাবিরা গরিব হলেও ইলম অর্জনে আগ্রহী ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের ইসলামের মেহমান বলে সম্মান দিতেন। আদর যত্ন করতেন। আজও যারা ইলমে দ্বীনের জন্য দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছে, তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সম্মান দেখানো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ। তাই সবার উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। সাধ্যমতো সাহায্য করা ও উৎসাহ দেওয়া।
ভয়েস/আআ