শনিবার, ২৬ Jul ২০২৫, ০২:০৮ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

সুদ-ঘুষের ভয়াবহতা

মুফতি উবায়দুল হক খান:

ইসলাম মানবজীবনের প্রতিটি দিকের সুশৃঙ্খল ও ন্যায়নিষ্ঠ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। এই ধর্ম শুধু নামাজ, রোজা বা ইবাদত-বন্দেগিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতিও গভীর মনোযোগ দেয়। ইসলাম এমন একটি সমাজ গঠনের আদেশ দেয়, যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে, অন্যায় দূর হবে এবং কেউ কারও হক নষ্ট করবে না। এই ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার পরিপন্থি দুটি ভয়ংকর অপরাধ হলো সুদ ও ঘুষ। কোরআন ও হাদিসে এই দুই পাপকর্মকে জঘন্য, সমাজবিধ্বংসী এবং আল্লাহর গজব ডেকে আনা অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

কোরআনের আলোকে সুদের ভয়াবহতা : সুদ অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত মুনাফা বা সময়ের বিনিময়ে অর্থ বাড়িয়ে নেওয়া। ইসলাম এ ধরনের লেনদেনকে চরম অন্যায় এবং মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং যদি সত্যিকার মুসলমান হয়ে থাকো তবে সুদের বাকি অংশ ছেড়ে দাও। যদি তা না করো, তবে জেনে রাখো, আল্লাহ ও তার রাসুলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারা ২৭৮-২৭৯)

এই আয়াতে সুদ খাওয়াকে এতটা ভয়ংকর বলা হয়েছে যে, সুদকারীদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তার রাসুল যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এটি কোরআনের সবচেয়ে কঠোর হুমকিগুলোর মধ্যে একটি।

হাদিসে সুদের ভয়াবহতা : হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) সুদের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেন, ‘আমি মেরাজে গমনকালে এমন এক জাতিকে দেখেছি, যাদের পেট গহিন ঘরের মতো বিশাল। তাতে সাপ ঢুকছে, যা বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? বলা হলো, এরা তারা, যারা সুদ খেত।’ (ইবনে মাজাহ ২২৭৩)

তিনি আরও বলেন, ‘সুদ গ্রহণকারী, সুদ প্রদানকারী, সুদের দলিল লিপিকার এবং সাক্ষীসহ সবার ওপর অভিশাপ বর্ষিত হয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম ১৫৯৮) এখানে সুদের সঙ্গে যুক্ত সব পক্ষই আল্লাহর লানতভুক্ত, এমনকি যারা কেবল সাক্ষ্য দেয় তারাও।

সমাজ ধ্বংসের নেপথ্য হাতিয়ার : সমাজ ধ্বংসের নেপথ্য হাতিয়ার হচ্ছে ঘুষ। ঘুষ মানে অন্যায় সুবিধা পাওয়ার জন্য কাউকে অবৈধভাবে অর্থ বা উপঢৌকন প্রদান করা। ঘুষ সমাজের ন্যায়বিচারকে ধ্বংস করে দেয়, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় এবং সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করে। ইসলাম ঘুষ গ্রহণকারী ও প্রদানকারী উভয়কে অভিশপ্ত ঘোষণা করেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়ের ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক।’ (তিরমিজি ১৩৩৭)

এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিচারকের কাছে ঘুষ দেয় এবং বিচারক ঘুষ নিয়ে অন্যায় রায় দেয়, তারা উভয়েই জাহান্নামে যাবে।’ (আবু দাউদ ৩৫৮০)

সুদ-ঘুষের পার্থক্য : সুদ মূলত আর্থিক লেনদেনে সময় ও ঝুঁকির বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ। ঘুষ হলো অবৈধ সুবিধা লাভের জন্য ঘনিষ্ঠ লেনদেন।

সুদ-ঘুষের মিল : উভয়টিই অন্যের হক নষ্ট করে। উভয়টিই সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। উভয়টির কারণেই গরিব গরিবই থাকে, আর ধনী আরও ধনী হয়। উভয়টিই ইসলামের দৃষ্টিতে কবিরা গুনাহ ও জঘন্য অপরাধ।

আধুনিক সমাজে সুদ-ঘুষের বিস্তার : আজকের বিশে^ সুদনির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থা, ঋণপ্রদান, মুনাফাভিত্তিক বিনিয়োগ এবং রাষ্ট্রীয় ঋণনীতি প্রমাণ করে যে সুদ আমাদের আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে গ্রাস করে ফেলেছে। অন্যদিকে ঘুষ এখন অনেক প্রতিষ্ঠানের গোপন চুক্তিতে পরিণত হয়েছে। নিয়োগ, টেন্ডার, শিক্ষা, চিকিৎসা এমনকি বিচার ব্যবস্থাও এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। এ সবকিছু ইসলামের আদর্শিক সমাজ কাঠামোর সম্পূর্ণ বিপরীত। সমাজে সুদ ও ঘুষের বিস্তারের কারণে ন্যায়ের পরিবর্তে অন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়, গরিব আরও নিপীড়িত হয় এবং মানুষের মধ্যে আস্থা ও সততা ধ্বংস হয়ে যায়।

দুনিয়াতে সুদ-ঘুষের পরিণতি : অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি হয়, সমাজে ঘৃণা ও হিংসা জন্ম নেয়, দুর্নীতির বিস্তার ঘটে, ন্যায়বিচার বিলুপ্ত হয়, রাষ্ট্রের কাঠামো দুর্বল হয়।

আখেরাতের শাস্তি : চিরস্থায়ী জাহান্নাম, আল্লাহর গজব ও লানত, রাসুল (সা.)-এর সুপারিশ থেকে বঞ্চিত হওয়া, হিসাবের দিনে কঠিন জবাবদিহিতা।

সুদ-ঘুষ থেকে পরিত্রাণের উপায় : এক. আল্লাহভীতি ও তাকওয়া অর্জন করা। দুই. হালাল উপার্জনের প্রতি যত্নবান হওয়া। তিন. সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়া। চার. ঘুষ গ্রহণ ও প্রদান থেকে দূরে থাকা, এমনকি প্রতিবাদ করা। পাঁচ. নৈতিকতা ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ছয়. শিক্ষা ও দাওয়াহর মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে : সুদ ও ঘুষ ইসলাম ধর্মে দুটি ভয়াবহ, জঘন্য ও ধ্বংসাত্মক অপরাধ। এই দুই অপরাধ শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কোরআন ও হাদিস থেকে আমরা দেখতে পাই, সুদ ও ঘুষের বিরুদ্ধে ইসলামে কড়া হুঁশিয়ারি এবং ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা রয়েছে। একজন প্রকৃত মুসলমানের উচিত, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হালাল ও পবিত্র পথ অনুসরণ করা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব হলো, নিজের জীবনকে সুদ ও ঘুষের অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখা এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক, পবিত্র সমাজ গঠনে অবদান রাখা। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে হালাল জীবিকা অর্জনের তওফিক দান করুন এবং সুদ ও ঘুষের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION